পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in ՀԵ মানিক রচনাসমগ্র শীতলের মিশ্র খাপছাড়া প্রকৃতিতেও বাৎসলোেব আবির্ভাব হইযাছে। বাৎসল্যের বসে তাহাব ভীরু উগ্রতাও যেন একটু নরম হইয়া আসিয়াছে। পিতৃত্বের অধিকার খাটাইয়া ছেলের সঙ্গে সে একটু মাখামাখি করিতে চায়, শ্যামা সভয়ে বাধা দিলে রাগ করার বদলে ক্ষুন্নাই যেন হয়—প্রকৃতপক্ষে, রাগ করার বদলে ক্ষুন্ন হয় বলিয়াই তাহার বিপজ্জনক আদরের হাত হইতে ছেলেকে বঁাচাইয়া চলিবার সাহস শ্যামার হয়। সে উপস্থিত না থাকিলে ছেলেকে কোলে তুলিতে শীতলকে সে বারণ করিয়া দিয়াছে। মাঝে মাঝে দু-চার মিনিটের জন্য ছেলেকে স্বামীর কোলে সে দেয কিন্তু নিজে কাছে দাঁড়াইয়া মাঝে মাঝে শীতল তাহাকে ফঁাকি দিবার চেষ্টা করে। রাত্রে হয়তো সে জাগিয়া আছে, খোকা কঁদিল। চুপিচুপি চৌকি হইতে নামিয়া মেঝেতে পাতা বিছানায় ঘুমন্ত শ্যামার পাশ হইতে খোকাকে সে সন্তৰ্পণে তুলিয়া লব্য-চােরের মতো। অনভ্যস্ত অপটু হাতে খোকাকে বুকেব। কাছে ধরিয রাখিযা নিজে সামনে পিছনে দুলিয়া তাহাকে সে দোলা দেয়, মৃদু গুনগুনানো সুরে ঘুমপাড়ানো ছড়া কাটে। বলে, আয় রে পাড়ার ছেলেরা মাছ ধরতে যাই, মাছের কঁাটা পায় ফুটেছে, দোলায় চড়ে যাই। রাতদুপুবে নিজের মুখে ঘুমপাড়ানো ছড়া শুনিয়া মুখখানা তাহার হাসিতে ভরিয়া যায়। এ ছেলে কার?--তাবা! শ্যামা মানুষ করিতেছে করুক, ছেলে শ্যামার নয়, তার। এদিকে শ্যামার ঘুম ভাঙে। কচি ছেলের বুড়ি মা কী আর ঘুমায়? লোক দেখানো চােখ বুজিয়া থাকে মাত্র। উঠিয়া বসিয়া শীতলের কাণ্ড চাহিয়া দেখিতে শ্যামার মন্দ লাগে না। কিন্তু মনকে সে বলে, কী হচ্ছে ? শীতল চমকাইযা খোকাকে প্রায় ফেলিয়া দেয়। শ্যামা বলে, ঘাড়টা বেঁকে আছে। ওর কত লাগছে বুঝতে পারছি ? লাগলে কঁাদত।—শীতল বলে। কঁদবে কী ? যে ঝাকানি বাকছু, আঁতকে ওর কান্না বন্ধ হয়েছে – শ্যামা বলে। শীতল প্রথমে ছেলে ফিরাইয়া দেয়। তারপর বলে, বেশ কবছি! অত তুমি লম্বা লম্বা কথা বলবে না বলে দিচ্ছি, খাপর্দার! শীতল শূইয়া পড়ে। সে সত্যসত্যই রাগ করিয়াছে অথবা এটা তার ফঁাকা গর্জন শ্যামা ঠিক তাহা বুঝিতে পারে না। খানিক পরে সে বলে, আমি কি বারণ করেছি। ছেলে দেব না! একটু বড়ো হোক, নিয়ো না তখন, যত খুশি নিয়ো। ওকে ধরতে বলে আমারই এখন ভয় করে! কত সাবধানে নাড়াচাড়া করি, তবু কালকে হাতটা মুচড়ে গেল শীতল বলে, আরো বাপরে বাপ! রাত দুপুরে বকরবকর করে এ যে দেখছি ঘুমোতেও দেবে না। শীতলের মেজাজ ঠান্ড হইয়া আসিয়াছে সন্দেহ নাই। রাগ সে করে না, বিরক্ত হয়। মন যে তাহার নরম হইয়া আসিয়াছে অনেক সময় এটুকু গোপন করিবার জন্যই সে যেন রাগের ভান করে, কিন্তু আগের মতো জমাইতে পারে না। মন্দাকে নেওয়ার জন্য তাহার শাশুডি বারবার পত্র লিখিতেছিলেন, মন্দা বারবার জবাব লিখিতেছিল যে পড়িয়া গিয়া তাহার কোমরে ব্যথা হইয়াছে, উঠিতে পারে না, এখন যাওয়া অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত শাশুড়ি বোধ হয় সন্দেহ করিলেন। এক শনিবার রাখালকে তিনি পাঠাইয়া দিলেন কলিকাতায়। রাখালের স্নেহ শ্যামা ভুলিতে পারে নাই, সে আসিয়াছে শুনিয়াই আনন্দে সে উত্তেজিত হইয়া উঠিল, কিন্তু আনন্দ তাহার টিকিল না। রাখালের ভাব দেখিয়া সে বড়ো দমিয়া গেল। এতকাল পরে তার দেখা পাইয়া রাখাল খুশি হইল মামুলি ধরনে, কথা বলিল অন্যমনে, সংক্ষেপে। শ্যামার ছেলের সম্বন্ধে তাহার কিছুমাত্র কৌতুহল দেখা গেল না।