পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in こbrこ মানিক রচনাসমগ্র এ রকম অবস্থায় তোমার তবে কিছু না বলাই ভালো, আনন্দ। কিছু বলছিও না। আমি। কী বলেছি? চুপ করে বসে আছি। আপনার যদি মনে হয়ে থাকে আমি বেশি কথা বলছি, আপনাব ভুল মনে হয়েছে জানবেন।... ওই দেখুন চাঁদ উঠেছে। আনন্দ মুখ তুলে চাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর হেরম্ব তাকায় তার মুখের দিকে। তার অবাধ্য বিশ্লেষণ-প্রিয় মন সঙ্গে সঙ্গে বুঝবার চেষ্টা করে তেজি আলোর চেয়ে জোৎস্নার মতো মৃদু আলোতে মানুষের মুখ আরও বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে কেন। আলো অথবা মানুষেব চোখ, কোথায্য এ ভ্রান্তির সৃষ্টি হয় ? হেরম্বের ধারণা ছিল কাব্যকে, বিশেষ করে চাঁদের আলোর কাব্যকে সে বহুকাল পূর্বেই কাটিযে উঠেছে। জ্যোৎস্নার একটি মাত্র গুণের মর্যাদাই তার কাছে আছে, যে এ আলো নিম্প্রভ, এ আলোতে চোখ জ্বলে না। অথচ, আজ শুধু আনন্দের মুখে এসে পড়েছে বলেই তার মতো সিনিকের কাছেও চাদের আলো জগতের আর সব আলোর মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে উঠল। হেরাম্বের বিশ্লেষণ-প্রবৃত্তি হঠাৎ একটা অভূতপূর্ব সত্য আবিষ্কার করে তাকে নিদারুণ আঘাত করে। কবির খাতা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও যে কবিতা নেই, কবির জীবনে পর্যন্ত নয়, তার এই জ্ঞান পুরোনো। কিন্তু এই জ্ঞান আজও যে তার অভ্যাস হয়ে যায়নি, আজ হঠাৎ সেটা বোঝা গেছে। কাব্যকে অসুস্থ নার্ভের টঙ্কার বলে জেনেও আজ পর্যন্ত তার হৃদয়ের কাব্যপিপাসা অব্যাহত রয়ে গেছে, প্রকৃতির সঙ্গে তার কল্পনার যোগসূত্রটি আজও ছিড়ে যায়নি। রোমান্সে আজও তার অন্ধ বিশ্বাস, আকুল উচ্ছসিত হৃদয়াবেগ আজও তার কাছে হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ পরিচয়, জ্যোৎস্না তাব চােখের প্রিয়তম আলো। হৃদয়েব অন্ধ সত্য এতকাল তার মস্তিষ্কের নিশ্চিত সত্যের সঙ্গে লড়াই করেছে। তাব ফলে, জীবনে কোনো দিকে তার সামঞ্জস্য থাকেনি, একধার থেকে সে কেবল করে এসেছে ভুল। দুটি বিরুদ্ধ সত্যের একটিকে সজ্ঞানে আর একটিকে অজ্ঞাতসারে একসঙ্গে মৰ্যাদা দিয়ে এসে জীবনটা তাব ভরে উঠেছে শুধু মিথ্যাতে। তার প্রকৃতির যে রহস্য, যে দুর্বোধ্যতা সম্মোহনশক্তির মতো মেয়েদের আকর্ষণ করেছে, সে তবে এই ? বৃঢ় বেদনা ও লজ্জার সঙ্গে হেরম্ব নিজেকে এই প্রশ্ন করে। মিথ্যার প্রকাণ্ড একটা স্তুপ ছাড়া সে আর কিছুই নয়, নিজের কাছে এই জবাব সে পায়। আনন্দের মুখ তার চোখেব সামনে থেকে মুছে যায়। আত্মোপলব্ধির প্রথম প্রবল আঘাতে তাব দেখবার অথবা শনিবার ক্ষমতা অসাড় হয়ে থাকে। এ সহজ কথা নয়। অন্তরের একটা পুরোনো শবগন্ধী পচা অন্ধকার আলোয় ভেসে গেল, একদা নিরবচ্ছিন্ন দুঃস্বপ্নেবি রাত্রি দিন হযে উঠল। এবং তা অতি অকস্মাৎ। এ বকম সাংঘাতিক মুহূর্ত হেরম্বের জীবনে আর আসেনি। এতগুলো বছর ধরে তার মধ্যে দুজন হেরম্ব গাঢ় অন্ধকারে যুদ্ধ করেছে, আজ আনন্দের মুখে-লাগা চাঁদের আলোয় তারা দৃশ্যমান হয়ে ওঠায় দেখা গেছে শত্ৰুতা করে পরস্পরকে দুজনেই তারা ব্যর্থ করে দিয়েছে। হেরন্সেব পরিচয়, ওদের লড়াই। আর কিছু নয়। ফুলের বেঁচে থাকবার চেষ্টার সঙ্গে কীটেব ধ্বংসপিপাসার দ্বন্দ্ব, এই বৃপকটাই ছিল এতকালের হেরম্ব। সমারোহের সঙেগ দিনের পর দিন নিজের এই অস্তিত্বহীন অস্তিত্বকে সে বয়ে বেড়িয়েছে। চকমকির মতো নিজের সঙ্গে নিজেকে ঠকে চারিদিকে ছড়িয়ে বেড়িয়েছে আগুন। কড়িকাঠের সঙ্গে দড়ি বেঁধে গলায় ফাস লাগিয়ে সে-ই উমাকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। সে খুনি! হেরম্ব নিঝুম হয়ে বসে থাকে। জীবনের এই প্রথম ও শেষ প্রকৃত আত্মচেতনাকে বুঝেও আরও ভালো করে বুঝবার চেষ্টায় জাল-টানা পচা পুকুরের বুদবুদের মতো অসংখ্য প্রশ্ন, অন্তহীন স্মৃতি তার মনে ভেসে ওঠে। আনন্দ দুবার তার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে তবে সে তার কথা শুনতে পায়।