পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in দিবারাত্রির কাব্য ՀԵ Գ নিষ্ঠুর ? ভয়ানক নিষ্ঠুর। আজ বাবার কাছে একটু ভালো ব্যবহার পেলে মা মদ ছোয় না। জেনেও বাবা উদাসীন হয়ে আছেন। এক এক সময় আমার মনে হয়, এর চেয়ে বাবা যদি কোথাও চলে যেতেন তাও ভালো ছিল। মা বোধ হয় তাহলে শান্তি পেত। বাবা যদি কোথাও চলে যেতেন! আনন্দও তাহলে প্রয়োজন উপস্থিত হলে নিষ্ঠুর চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে পারে? মালতীর দুঃখের চেয়ে আনন্দের এই নূতন পরিচয়টিই যেন হেরম্বের কাছে প্রধান হয়ে থাকে। তার নানাকথা মনে হয। মালতীর অবাঞ্ছনীয় পরিবর্তনকে আনন্দ যথোচিতভাবে বিচার কবতে অক্ষম, নয় জেনে সে সুখী হয়। মালতীর অধঃপতন রহিত করতে অনাথকে পর্যন্ত সে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেবার ইচ্ছা পোষণ করে, মালতীর দােষগুলো তার কাছে এতদূব বর্জনীয়। মাতৃত্বে অধিকারে যা খুশি করবার সমর্থন আনন্দেব কাছে মালতী পায়নি। শুধু তাই নয়। আনন্দের আরও একটি অপূর্ব পরিচযা তার মালতী সম্পৰ্কীয় মনোভাবের মধ্যে আবিষ্কার করা যায়। মালতীকে সে দোষী বলে জানে, কিন্তু সমালোচনা কবে না, তাকে সংস্কৃত ও সংশোধিত করবার শতাধিক চেষ্টায় অশান্তির সৃষ্টি করে না। মালতীকে কীসে বদলে দিয়েছে আনন্দ তা জানে। কিন্তু জানাব চেয়েও যা বড়ো কথা, মনোবেদনােব এই বিকৃত অভিব্যক্তিকে সে বোঝে, অনুভব করে। জীবনের এই যুক্তিহীন অংশটিতে যে অখণ্ড যুক্তি আছে, আনন্দেব তা অজানা নয। ওর বিষগ্ন মুখখানি হেরম্বের কাছে তার প্রমাণ দিচ্ছে। আনন্দ চুপ করে বসে আছে । তার এই নীরবতার সুযোগে তাকে সে কতদিক দিয়ে কতভাবে বুঝেছে হেরম্বের মনে তাক চুলচেরা হিসাব থাকে। কিন্তু এক সময় হঠাৎ সে অনুভব করে এই প্রক্রিয়া তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আনন্দকে বুদ্ধি দিযে বুঝবার চেষ্টায় তার মধ্যে কেমন একটা অনুত্তেজিত অবসন্ন জ্বালা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সম্মুখে পথ অফুরন্ত জেনে যাত্রার গোড়াতেই অশ্রান্ত পথিকের যেমন স্তিমিত হতাশা জাগে, একটা ভারবোধ তাকে দমিযে বাখে, সেও তেমনি একটা ঝিমানো চেপে-ধরা কষ্টের অধীন হয়ে পড়েছে। আনন্দের অন্তরগুগ প্রশ্রয়ে তার যেন সুখ নেই। হেরম্ব বিছানায উঠে বসে। লন্ঠনের এত কাছে আনন্দ বসেছে যে তাকে মনে হচ্ছে জ্যোতির্ময়ী, আলো যেন লন্ঠনেব নয। হেরম্ব অসহায় বিপন্নের মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আরও একটি অভিনব আত্মচেতনা খুজে পায়। তাব বিহ্বলতার সীমা থাকে না , সন্ধ্যা থেকে আনন্দকে সে যে কেন নানাদিক থেকে বুঝবার চেষ্টা করছে, এতক্ষণে হেরম্ব সে রহস্যের সন্ধান পেয়েছে। ঝড়ো রাত্রির উত্তাল সমুদ্রের মতো অশান্ত অসংযত বৃদয়কে এমনিভাবে সে সংযত করে রাখছে, আনন্দকে জানিবার ও বুঝবাব এই অপ্ৰমত্ত ছলনা দিয়ে। আনন্দ যেমনি হােক কী তার এসে যায় ? সে বিচার পড়ে আছে সেই জগতে, যে জগৎ আনন্দের জন্যই তাকে অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। জীবনে ওর যত অনিয়ম - যত অসঙ্গতিই থাক, কীসের সঙ্গে তুলনা করে সে তা যাচাই করবে ? আনন্দকে সে যে স্তরে পেয়েছে সেখানে ওর অনিয়ম নিয়ম, ওর অসঙ্গতিই সঙ্গতি । ওর অনিবাৰ্য আকর্ষণ ছাড়া বিশ্বজগতে আজ আর দ্বিতীয় সত্য নেই ; ওর হৃদয়মনের সহস্র পরিচয় সহস্রবার আবিষ্কার করে তার লাভ কী হবে? তার মোহকে সে চরম পরিপূর্ণতার স্তরে তুলে দিয়েছে, তাকে আবার গোড়া থেকে শুরু করে বাস্তবতার ধাপে ধাপে চিনে গিয়ে । —ল তিল করে মুগ্ধ হবার মানে কী হয়। এ তারই হৃদয়মনের দুর্বলতা। ঈশ্বরকে কৃপাময় বলে কল্পনা না করে যে দুর্বলতার জন্য মানুষ ঈশ্বরকে ভালোবাসতে পারে এ সেই দুর্বলতা। আনন্দকে আশ্রয় করে যে অপার্থিব অবোধ অনুভূতি নীহারিকালোকের রহস্য-সম্পদে তার চেতনাকে পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে দিতে চায়, পৃথিবীর মাটিতে প্রোথিত সহস্র শিকড়ের বন্ধন থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে উধ্বায়ত জ্যোতিস্তরের মতো তাকে উত্ত্বঙ্গ আত্মপ্রকাশে সমাহিত করে ফেলতে চায়, সেই অব্যক্ত অনুভূতি ধারণ করবার শক্তি হ্রদায়ের