পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in NRF O মানিক রচনাসমগ্ৰ হেরম্ব হঠাৎ তার সামনে দাঁড়াল। ব্যায়াম করছি, আনন্দ । বায়াম শেষ হয়ে থাকলে বসে বিশ্রাম করুন। হেরম্ব তৎক্ষণাৎ বসল। বলল, তুমি বারবার মুখ ধুযে আসছ কেন ? মুখে ধুলো লাগে যে। আনন্দ হাসবার চেষ্টা করল। তাদের অদ্ভুত নিরবলম্ব অসহায় অবস্থাটি হেরম্বের কাছে হঠাৎ প্রকাশ হয়ে যায়। তাদের কথা বলা অর্থহীন, তাদের চুপ করে থাকা ভংয়কব। পায্যের তলা থেকে তাদের মাটি প্রাব্য সরে গেছে, তাদেব আশ্রয় নেই। মানুষের বহুযুগেব গবেষণাপ্রসূত সভ্যতা আর তাবা ব্যবহাব করতে পারছে নঃ। দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ ও ধর্ম, এমনকী, ঈশ্বরকে নিয়ে পর্যন্ত তাদের আলাপ-আলোচনা অচল, এতদূব আচল যে, পাঁচ মিনিট ও সব বিষয়ে চেষ্টা করে কথা চালালে নিজেদের বিশ্ৰী অভিনয়ের লজ্জাম তারা কণ্টকিত হয়ে উঠবে। এই কক্ষের বাইরে জ্ঞান নেই, সমস্যা নেই, প্রয়োজনীয় কিছু নেই। -- মানুষ পর্যন্ত নেই। তাদের কাছে বাইরের জগৎ মুছে গেছে, আব্ব সে জগৎকে কোনো ছলেই এ ঘরে টেনে আনা যাবে না। একান্ত ব্যক্তিগত কথা ছাড়া তাদের আর বলবার কিছু নেই। অথচ এই সীমাবদ্ধ। আলাপেও যে কথাগুলো তারা বলতে পারছে সেগুলো বাজে, অবান্তর। বোমার মতো ফেটে পড়তে চেয়ে তাদের তুড়ি দিয়ে খুশি থাকতে হচ্ছে। এ অবস্থা সুখের নয়, কাম্য নয়, হেরম্বের তা স্বীকার করতে হল। কিন্তু ক্ষতিপূৰ্ব্বণ যে এই অসুবিধাকে ছাপিয়ে আছে। এ কথা জানতেও তার বাকি ছিল না। পৰস্পরের কত অনুচ্চাবিত চিন্তাকে তারা শুনতে পাচ্ছে। তাদের কত প্রশ্ন ভাষায় বুপ না নিয়েও নিঃশব্দ জবাব পাচ্ছে। শাডির প্রান্ত টেনে নামিযে পায়ের পাতা ঢেকে দিয়ে বলছে, পা দুটি তার অত করে দেখবার মতো নয় ; আঁচলের তলে হাত দুটি আড়াল করে বলছে, পা দেখতে দিলাম না বলে তুমি আমন করে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তা হবে না। সে তার মুখের দিকে চেয়ে জবাব দিচ্ছে এবার তুমি মুখ ঢাক কী করে দেখি ! আনন্দের মৃদু রোমাঞ্চ ও আরক্ত মুখ প্রতিবাদ করে বলছে, আমাকে এমন কবে হার মানানো তোমার উচিত নয়। দবাজার দিকে চেযে আনন্দ ভয় দেখাচ্ছে। আমি ইচ্ছে করলেই উঠে চলে যেতে পাবি। হঠাৎ তাৰ মূপে বিষন্নতা ঘনিয়ে আসছে। তার চোখ ছলছল করে উঠছে। চোখের পলকে সে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এও ভাষা, সুস্পষ্ট বাণী ! কিন্তু এর অর্থ অতল, গভীব, বহস্যময়। তার কত, ভয়, কত প্রশ্ন, নিজের কাছে হঠাৎ নিজেই দুর্বোধ্য হয়ে উঠে তার কী নিদারুণ কষ্ট, হেরম্ব কি তা জানে? তার মন কতদূর উতলা হযে উঠেছে হেরম্ব কি তার সন্ধান বাখে? একটা বিপুল সম্ভাবনা গৃহা-নিরুদ্ধ নদীর মতো তাকে যে ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে, হেরম্ব তাও কি জানে ? হযতো আজ থেকেই তার চিরকালের জন্য দুঃখের দিন শুরু হল, এ আশঙ্কা যে তার মনে জ্বালার মতো জেগে আছে, হেরম্ব কি তা কল্পনাও করতে পারে ? নিঃশব্দ নির্মম হাসির সঙেগ। উদাসীন চোখে খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে হেরম্ব জবাব দিচ্ছে ; দুঃখকে ভয় কোরো না! দুঃখ মানুষের দুর্লভতম সম্পদ! তাছাড়া আমি আছি। আমি! কথার অভাবে তাদের দীর্ঘতম নীরবতার শেষে আনন্দ বলল, চলুন, নাচ দেখবেন। আনন্দের নাচ যে বাকি আছে, সে কথা হেরম্বের মনে ছিল না। চলো। বেশ পরিবর্তন করবে না ? করব। আপনি বাইরে গিয়ে বসুন।