পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in Vo)O মানিক রচনাসমগ্র কোনো অর্থ সে খুঁজিয়া পাইল না। এমন যদি হইত। যে মন্দার স্বভাব ভালো নয়, সে দেখিতে কুৎসিত, তাহাকে লইয়া রাখাল সুখী হইতে পারে নাই—আবার বিবাহ করিবার কারণটা তাহার শ্যামা বুঝিতে পারিত। মনের মিল তো দুজনের কম হয় নাই? এ বাড়িতে পা দিয়া অসুস্থ মন্দার যে সেবাটািই রাখালকে সে করিতে দেখিয়াছিল তাও শ্যামার মনে আছে। এমন কাজ। তবে সে কেন করিল ? শ্যামা ভাবে, ঘুমাইতে পারে না। চৌকির উপর শীতল নাক ডাকায়, ঘুমন্ত সন্তানের মুখ হইতে স্তন আলগা হইয়া খসিয়া আসে, জননী শ্যামা আহত উত্তেজিত বিষন্ন মনে আর একটি জননীর দুর্ভাগ্যের কথা ভাবিয়া যায়। রাখালের অপকার্যের একটা কারণ খুজিয়া পাইলে সে যেন স্বস্তি পাইত। কে বলিতে পারে এ রকম বিপদ তারও জীবনে ঘটিবে কিনা ? শীতল তো রাখালের চেয়ে ভালো লোক নয়। কীসের যোগাযোগে স্ত্রী ও জননীর কপাল ভাঙে মন্দার দৃষ্টান্ত হইতে সেটুকু বোঝা গেলে মন্দ হইত না। তারপর একটা কথা ভাবিয়া হঠাৎ শ্যামার হাত-পা অবশ হইয়া আসে। মন্দা জননী বলিয়াই হয়তো রাখালের স্ত্রীর প্রয়োজন হইয়াছে? ছেলের জন্য মন্দা স্বামীকে অবহেলা করিয়াছিল, স্ত্রী-বর্তমানে রাখাল স্ত্রীর অভাব অনুভব করিয়াছিল, হয়তো তাই সে আবার বিবাহ করিয়াছে ? পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিয়া শীতল দেখিল, বুকের উপব কুঁকিয়া মুখেব কাছে হাসিভরা মুখখানা আনিয়া শ্যামা তাহাকে ডাকিতেছে। শ্যামা যে রাত্ৰেই প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিল ছেলের জন্য কখনও সে স্বামীকে তাহার প্রাপা হইতে বঞ্চিত করিবে না, শীতল তো তাহা জানিত না, এও জানিত না যে প্ৰতিজ্ঞা-পালনে স্বামীব ঘুম ভাঙিবার নিয়মিত সময় পর্যন্ত সবুর শ্যামার সহে নাই। শীতল তাহাকে ধাক্কা দিয়া সরাইয়া দিল। বলিল, হয়েছে কী ? বেলা হল উঠবে না ? শীতল পাশ ফিরিযা শুইল। বিড়বিড় করিয়া সে যা বলিল তা গালাগালি। তখন শ্যামা বুঝিতে পারিল সে ভুল করিয়াছে। ছেলের জন্য স্বামীকে অবহেলা না করিবার প্রক্রিয়া এটা নয়। স্বামী যতটুকু চাহিবে দিতে হইবে ততটুকু, গায়ে পড়িয়া সোহাগ করিতে গেলে জুটিবে গালাগালি। মন্দার কোনো পরিবর্তন নাই। সে তো এখনও জানে না। ছেলেদের লইয়া সে ব্যস্ত ও বিব্রত হইয়া রহিল। আড়াচোখে তাহার সানন্দ চলাফেরা দেখিতে শ্যামার বড়ো মমতা হইতে লাগিল। সে মনে মনে বলিল, আ পোডাকপালি! বেশ হেসে খেলে সময় কাটােচ্ছ, ওদিকে তোমার যে সর্বনাশ হয়ে গেছে। যখন জানবে তুমি করবে। কী ?--একটা বিড়ালছােনাবা জন্য মারামারি করিয়া কানু ও কালু কঁদিতেছিল। দেখাদেখি কোলের ছেলেটিও কান্না জুড়িয়াছিল। শ্যামা সাহায্য করিতে গেলে মন্দা তাহাকে হাঁটাইয়া দিল। তিনজনকে সে সামলাইল একা। শ্যামার চোখ ছলছল করিতে লাগিল। সে মনে মনে বলিল, কার ছেলেদের এত ভালোবাসছ ঠাকুরঝি ? সে তো তোমার মান রাখেনি। মন্দার সমস্যা শ্যামাকে বড়ো বিচলিত করিয়াছে। রাখালের প্রতি সে যেন ক্ৰমে ক্ৰমে বিদ্বেষ বোধ করিতে আরম্ভ করে। সংসারে স্ত্রীলোকের অসহায় অবস্থা বুঝিতে পারিয়া নিজের কাছে সে অপদস্থ হইয়া যায়। যে আশ্রয় তাহাদের সবচেয়ে স্থায়ী কত সহজে তাহা নষ্ট হইয়া যায়। যে লোকটির উপর সবদিক দিয়া নির্ভর করিতে হয়, কত সহজে সে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া বসে ? মন্দা অবশ্যই এবার অনেক দিন। এখানে থাকিবে। এ আরেক সমস্যার কথা। আর্থিক অবস্থা তাহাদের সচ্ছল নয়, নতুন চাকরিতে শীতল নিয়মিত মাহিনা পায় বটে, টাকার অঙ্কটা কিন্তু ছোটাে। শীতলের কিছু ধারা আছে, মাঝেমাঝে কিছুকিছু শুধিতে হয়, সুদও দিতে হয়। খরচ চলিতে চায় না।