পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in vS)) 8 মানিক রচনাসমগ্ৰ কোথায় চলে গেছেন ? আনন্দের চোখ ছলছল করে এল। তা জানিনে তো। তোমার কাছ থেকে যখন টাকা নিয়ে দিলাম, তখন কিছু বললেন না। তোমরা চলে যাবার পর বাবা আমাকে ডেকে চুপিচুপি বললেন, আমি যাচ্ছি। আনন্দ, তোর মাকে বলিস না, গোল করবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যােচ্ছ বাবা, কবে ফিরবে? বাবা জবাবে বললেন, সে সব কিছু ঠিক নেই। আমি বুঝতে পেরে কঁদতে লাগলাম। বলে আনন্দ চোখ মুছতে লাগল। হেরম্ব তাকে একটি সান্তনার কথাও বলতে পারল না। বাতাসের নাড়া খেযে গাছের পাতা থেকে জল ঝরে পড়ছে, আনন্দ প্ৰায় ভিজে গিয়েছিল। তাকে সঙ্গে করে হেরম্ব ঘরে গেল। জানােলা কেউ বন্ধ করেনি। বৃষ্টির জলে মেঝে ভেসে গিয়েছে। হেরম্বের বিছানাও ভিজোছে। বিছানাটা উলটে নিয়ে হেরম্ব তোশকের নীচে পাতা শুকনো শতরঞ্চিতে বসল। বলার অপেক্ষণ না রেখে আনন্দও তার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। সে অল্প কঁপিছিল, জলে ভিজে কিনা বলবার উপায নেই। হেরম্বেব মনে হল সান্তনার জন্য যত নয়, নির্ভরতার জন্যই আনন্দ ব্যাকুল হয়েছে বেশি। এ রকম মনে হওয়ার কোনো সঙ্গত কারণ ভেবে না পেয়ে হেরম্ব তাকে সান্তনাও দিল না, নির্ভরতাও দিল না। সে বরাবর লক্ষ করেছে। এ রকম অবস্থায় ঠিকমতো না বুঝে কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়। আনন্দ বলল, মা কি হয়েছে জান ? বাবাকে টাকা দিয়েছি বলে আমাকে মেরেছে। হেবম্বোব দিকে পিছন ফিরে পিঠের কাপড় সে সরিয়ে দিল, দ্যাখ কী রকম মেরেছে। এখনও ব্যথা কমেনি। ঘযা লেগে জ্বালা করে বলে জামা গায়ে দিতে পারিনি, শীত করছে, তবু। কী দিয়ে মেরেছে জান ? বাবার ভাঙা ছড়িটা দিয়ে। তার সমস্ত পিঠ জুড়ে সত্যিই ছড়ির মোটা মোটা দাগ লাল হয়ে উঠেছে। হেরম্ব নিশ্বাস বোধ করে বলল, তোমায় এমন করে মেরেছে! আনন্দ পিঠ ঢেকে দিয়ে বলল, আরও মারত, পালিয়ে গেলাম বলে পারেনি। বৃষ্টির সময় মন্দিরে বসেছিলাম। তুমি যত আসছিলে না, আমি একেবারে মরে যাচ্ছিলাম। তিনি বুঝি আসতে দেননি। যার সঙ্গে গেলে ? হ্যা, তার স্বামী আমাকে না খাইয়ে ছাড়লে না। পিঠে হাত বুলিয়ে দেব আনন্দ ? না, জ্বালা করবে। হেরম্ব ব্যাকুল হয়ে বলল, একটা কিছু করতে হবে তো, নইলে জ্বালা কমবে কেন ? আচ্ছা সেঁক দিলে হয় না? বলে হেরম্ব নিজেই আবার বলল, তাতে কী হবে ? এখন জ্বালা কমেছে। কমেনি, জ্বালা টেব পােচ্ছ না। তোমার পিঠ অসাড় হয়ে গেছে। বরফ ঘসে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত। তা হত। কিন্তু বরফ নেই। তুমি বরং আস্তে আস্তে হাত বুলিয়েই দাও। বোসো, বরফ নিয়ে আসছি। আনন্দের প্রতিবাদ কানে না তুলে হেরম্ব চলে গেল। শহর পর্যন্ত হেঁটে যেতে হল। বরফ কিনে সে ফিরে এল গাডিতে। আনন্দ ইতিমধ্যে মেঝের জল মুছে ভিজে বিছানা বদলে ফেলেছে। সে যে সোনার পুতুল নয। এই তার প্রমাণ। এত কষ্ট করে বরফ সংগ্রহ করে এনেও এক ঘন্টার বেশি আনন্দের পিঠে ঘষে দেওয়া গোল না। বরফ বড়ো ঠান্ডা। আনন্দ চুপ করে শূয়ে রইল, হাত গুটিয়ে বসে রইল হেরম্ব। যে কোনো কারণেই হোক, আনন্দকে মালতী যে এমনভাবে মারতে পারে সে যেন ভাবতেই পারছিল না।