পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in ५६ খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছটার গুড়িতে ঠেস দিয়া হার ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষা করিলেন। হারুর মাথার কঁচা-পাকা চুল আর মুখের বসন্তের দাগভরা বৃক্ষ চামড়া ঝলসিয়া পুড়িয়া গেল। সে কিন্তু কিছুই টের পাইল না। শতাব্দীর পুরাতন তবুটির মুক অবচেতনার সঙ্গে একান্ন বছরের আত্মমমতায় গড়িয়া তোলা চিন্ময় জগৎটি তাহার চােখের পলকে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। কটাক্ষ কবিয়া আকাশের দেবতা দিগন্ত কঁপাইয়া এক হুংকার ছাড়িলেন । তারপর জোরে বৃষ্টি চাপিয়া আসিল । বটগাছের ঘন পাতাতেও বেশিক্ষণ বৃষ্টি আটকাইল না। হারু দেখিতে দেখিতে ভিজিয়া উঠিল। স্থানটিতে ওজনের ঝাঁঝালো সামুদ্রিক গন্ধ ক্ৰমে মিলাইয়া আসিল। অদূরের ঝোপটির ভিতর হইতে কেয়াব সুমিষ্ট গন্ধ ছড়াইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। সবুজ বঙের সবু লিকলিকে একটা সাপ একটি কেয়াকে পাকে পাকে জড়াইয়া ধরিয়া আচ্ছন্ন হইয়া ছিল । গাযে বৃষ্টির জল লাগায় ধীরে ধীরে পাক খুলিয়া ঝোপেব বাহিবে আসিল। ক্ষণকাল স্থিরভাবে কুটিল আপলক চোখে হারুব দিকে চাহিয থাকিয়া তাহার দুই পায়ের মধ্য দিয়াই বটগাছের কোটরে অদৃশ্য হইয়া গেল।. হারুকে সহজে এখানে কেহ আবিষ্কার করিবে এরূপ সম্ভাবনা কম। এদিকে মানুষের বসতি নাই। এদিকে আসিবার প্রয়োজন কাহারও বডো একটা হয় না, সহজে কেহ আসিতেও চায় না। গ্রামেব লোক ভযা করিতে ভালোবাসে। গ্রামের বাহিরে খালেব এপারেব ঘন জঙ্গল ও গভীব নিৰ্জনতাকে তাহারা ওই কাজে লাগাইয়াছে। ভূতপ্রেতেব অস্তিত্ব হয়তো গ্রামবাসীবই ভীরু কল্পনায়, কিন্তু স্থানটি যে সাপের বাজা তাতে আর সন্দেহ নাই । দিনের আলো বজায় থাকিতে থাকিতে বাজিতপুরেব দুএকটি সাহসী পথিক মাঠ ভাঙিয়া আসিয ঘাসেব নীচে অদৃশ্যপ্রায় পথ-বেখাটিব সাহায্যে পথ সংক্ষেপ কবে। যলিযা কহিযা কারও নৌকায় খালি পার হইলেও গাওদিযর সড়ক। গ্রামে পৌছিতে আর আধ মাইলও হাঁটিতে হয় না। চণ্ডীর মা মাঝে মাঝে দুপুরবেলা এদিকে কাঠ কুড়াইতে আসে। যামিনী কবিরাজেব চেলা সপ্তাহে একদিন গুম্মলতা কুড়াইযা লইয়া যায়। কার্তিক আত্মান মাসে ভিনগায়েব সাপুড়ে কখনও সাপ ধরিতে আসে। আর কেহ ভুলিয়াও এদিকে পা দেয় না। বৃষ্টি থামিতে বেলা কাবার হইয়া আসিল। আকাশের এক প্রান্তে ভীরু লজ্জার মতো একটু রঙের আভাস দেখা দিল। বটগাছের শাখায় পাখিরা উড়িযা আসিয়া বসিল এবং কিছু দূরে মাটির গায়ের গর্ত হইতে উই-এর দলকে নবােদগত পাখা মেলিয়া আকাশে উড়িতে দেখিয়া হঠাৎ আবার সেই দিকে উড়িয়া গেল। হারুর স্থায়ী নিস্পন্দতায় সাহস পাইয়া গাছের কাঠবিড়ালিটি এক সময় নীচে নামিয়া আসিল। ওদিকে বুদি গাছের ডালে একটা গিরগিটি কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকগুলি পোকা আয়ত্ত করিয়া ফেলিল। মরা শালিকের বাচ্চাটিকে মুখে করিয়া সামনের মাঠ দিয়া ছপছপা করিয়া পার হইয়া যাওয়ার সময় একটা শিয়াল বারবার মুখ ফিরাইয়া হারুকে দেখিয়া গেল। ওরা টের পায়। কেমন করিয়া টের পায় কে জানে!