পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in \Sე\Sეხr মানিক রচনাসমগ্র ঘাটে কয়েকটি ছোটাে বড়ো নীেকা বঁধা ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে একটিতেও এখন না আছে আলো, না আছে মানুষ। গোবর্ধনের মনে ভয় ছিল, তাহাকে নীেকায় পাহারা রাখিয়া শশী হয়তো নিজেই গ্রামে যাইতে চাহিবে। ঘাটে নীেকা বঁধিয়াই সে তাই বলিল, আমি তাহলে গাঁয়ে খবর দিগে ছোটােবাবু? শশী বলিল, যা। পা চালিয়ে যাস গোবর্ধন। আগে যাবি গোয়ালাপাড়ায়। নিতাই, সুদেব, বংশী ওরা সবাই যেন ছুটে চলে আসে। বলিস, আমি অন্ধকারে মড়া আগলে বসে রইলাম। আলোটা তুই নিয়ে যা, যেতে যেতে ঘুরাঘুট্টি অন্ধকার হবে। পিছল রাস্তা। আলো লইয়া গোবর্ধন চলিয়া গেল। এতক্ষণে সন্ধ্যা হইয়াছে। আকাশ খুজিলে হয়তো এখনও একটু ধুসর আভা চোখে পড়ে, কিন্তু অন্ধকার দ্রুত গাঢ় হইয়া আসিতেছে। শশী ভাবিল, আর পনেবো বিশ মিনিট দেরি করিয়া বটগাছটার কাছে পৌছিলে হারুকে সে ঠাহর করিতে পারিত না। খালি দিয়া যাতায়াত করিবার সময় ভূত ও সাপের রাজ্যটির দিকে সে বিবাবর চোখ তুলিয়া তাকায়। আজও তাকাইত! কিন্তু হারুকে তাহার মনে হইত গাছের গুড়িরই একটা অংশ। হয়তো মানুষের আকৃতিত্ব সঙ্গে গাছের অংশটির সাদৃশ্য লক্ষ করিয়া আর হারুব পরনের কাপড়ের শ্বেতাভ বহস্যটুকুর মানে না বুঝিয়া তাহার একটু শিহরন জাগিত মাত্র। হারু ওইখানে পড়িয়া থাকিত। কতদিন পরে শিযালের দাঁত ও শকুনির চঞ্চতে সাফ করা হাড় কয়খানি তাহার মানুষ আবিষ্কার কবিতা কে জানে। পঞ্চাকে চণ্ডীর মা যেমন আবিষ্কার করিয়াছিল। সর্বাঙ্গে খাবলা খাবালা পচা মাংস,কোথাও হাড় বাহির হইয়া পড়িয়াছে। দুই হাতের মুঠার মধ্যে প্রকাণ্ড খরিশ সাপটা শুকাইয়া হইয়া আছে একেবাবে দাডি। স্রোতের বেগে নীেকা মৃদু মৃদু দুলিতেছিল। নীেকার গলুইয়ে সে দোলন একটা জীবন্ত প্রাণীর অস্থিরতার মতো পৌছিতেছে। নড়িয়া চড়িয়া শশী একসময় সোজা হইযা বসে। মনে একটা বিড়ি ধরাইবার ইচ্ছা জাগিতেছিল। কিন্তু সেটুকু উৎসাহও সে যেন পায না। তাহার চােখেব সামনে চারিদিক ক্ৰমে গাঢ় অন্ধকারে ঢাকিয়া যায়। তীরেব গাছগুলি জমাটবাঁধা অন্ধকাবের বুপ নেয়, জলেব উপর জনহীন নীেক কখনও হালকা ছায়ার মতো আলগোছে ভাসিতে থাকে। মাথাব্য উপর দিয়া অদৃশ্যপ্রায় কতগুলি পাখি সাঁ সঁ শব্দ করিয়া উড়িয়া যায়। চারিদিকে জোনাকি ঝিকমিক করিতে আরম্ভ করে । এত কাছেও হারুর মুখ ঝাপসা হইয়া যায়। তাহার মুখখানা ভালো করিয়া দেখিবার চেষ্টায় ব্যর্থ হইয়া সে যে মরিয়া গিয়াছে এই সত্যটা শশী যেন আবার নূতন কবিয়া অনুভব করে। ভাবে, মরিবার সময় হারু কী ভাবিতেছিল কে জানে! কোন কল্পনা কোন অনুভূতিব মাঝখানে তাহাব হঠাৎ ছেদ পডিয়াছিল ? মেয়ের জন্য পাত্ৰ দেখিতে হারু বাজিতপুরে গিয়াছিল এটা শশী জানিত। পথ সংক্ষেপ কবিবার জন্য ওই বিপথে সে পাড়ি জমাইয়াছিল। পথ তাহার সংক্ষিপ্তই হইয়া গেল। পাড়িও জমিল ভালোই। ঘণ্টা দুই পাবে গোটা তিনেক লণ্ঠন সঙ্গে করিয়া হারুর সাত-আটজন স্বজাতি আসিয়া পড়িল। নিস্তব্ধ ঘাটটি মুহুর্তে হইয়া উঠিল মুখরিত। শশী সংগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, নিতাই এসেছ, নিতাই ? নিতাই সাড়া দিল, আজ্ঞে, এই যে আমি ছোটােবাবু। নিতাইয়ের দায়িত্বজ্ঞান প্ৰসিদ্ধ। শশী অনেকটা ভরসা পাইল । হারুর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে নিতাই ? হয়েছে ছোটোবাবু।