পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা VISIÓNS} আলো উচু করিয়া ধরিয়া সকলে তাহারা ভিড় কবিয়া হারুকে দেখিতে লাগিল। গোবর্ধনেব কাছে ব্যাপারটা তাহারা আগাগোড়া শুনিয়াছিল। শশীব কাছে আর একবার শুনিল। তারপর ঘাটের খাঁজের উপর উবু হইয়া বসিয়া আরম্ভ করিয়া দিল জটলা। কিছুক্ষণের মধ্যে শশীর মনে হইল, হারুর পরলোকগমন ওদের কথার মধ্যেই এতক্ষণে শোচনীয় হইয়া উঠিতেছে। বর্ষণক্ষান্ত বিষন্ন রাত্রে কালিপড়া লণ্ঠনের মৃদু রঙিন আলোয় হারুর জীবনের টুকরো টুকবো ঘটনাগুলি যেন দৃশ্যমান ছায়াছবির বৃপ গ্ৰহণ করিয়া চোখের সামনে ভাসিয়া আসিতে লাগিল। হারুর পরিবারের ক্ষতি ও বেদনার প্রকৃত উপলব্ধি যেন এতক্ষণে শশী আয়ত্ত করিতে পারিল। সে বুঝিতে পারিল, সংসারে হাবু যে কতখানি স্থান শূন্য রাখিয়া গিয়াছে—এই অশিক্ষিত মানুষগুলির মনের মাপকাঠি দিয়াই তাহার পরিমাপ সম্ভব। এতক্ষণ হারুর অপমৃত্যুকে সে বুঝিতে পারে নাই। হাবুকে সে আপনার জগতে তুলিয়া লইয়াছিল। যেখানে শূন্য করিয়া রাখিয়া যাওয়ার মতো স্থান হারু কোনোদিন অধিকার করি যা ছিল কি না সন্দেহ। নীরবে শশী অনেকক্ষণ তাঁহাদের আলোচনা কান পাতিযা শুনিল। শেষে রাত বাড়িয়া যাইতেছে খেযাল করিয়া বলিল, তোমাবা তাহলে আব্ব বসে থেকে না নিতাই। রসিকবাবুব বাগান থেকে বঁাশ কেটে এনে একটা মাচা বেঁধে ফেলে। নিতাই প্রশ্ন শিবিল, সোজা মশান বিলে নিয়ে যাবে কি ছোটােবাবু ? শশী বলিল, না । ওর বাড়িতে, একবার নামাতে হবে। হারুকে সোজাসুক্তি শ্মশানে লইয়া গেলে অনেক হাঙ্গামা কমিত। কিন্তু হারুব মেয়ে মাতিব জুল। সকলে শ্মশানে আসিলেও সে আসিতে পরিবে না। তাহাকে একবাব না দেখাইয়া হারুকে পোড়াইয়া ফেলিবার কথাটা শশী ভাবিতেও পারিতেছিল না। মাতিব কাছে খবরটা এখন কযেক দিনের জন্য চাপিয়া যাওযার বুদ্ধিও বাড়ির কাহারও হইবে কি না সন্দেহ। মতি জানিতে পাবিবে। তাহাবই জন্য বব খুজিতে গিয ফিবিবার পথে হার অপঘাতে প্রাণ দিয়াছে। জুর গাযে এই বর্ষার রাত্রে হয়তো সে শ্মশানে ছুটিযা আসিলে। জোব করিয়া বাড়িতে আটকাইয়া রাখিলে সকলকেই হয়তো সে ক্ষমা কবিবে, নিয়তিকে পর্যন্ত, কিন্তু শশীকে সে সহজে মার্জনা কবিবে না। বলিবো : আপনি থাকতে আমাকে একটিবাবও না দেখিয়ে বাবাকে ওরা পুড়িয়ে ফেলেছিল। গো । বসিকলাকুব বাগান হইতে বঁাশ কাটিয়া আনিয়া মাচা বাধা হইল। তাবপব মাচায শোয়াইয়া হরিবোল দিয়া মাচাটা তাহাবা কঁধে তুলিয়া লইল । শশী বলিল, এখন তোমরা হরিবোল দিও না, হাবু শ্মশান যাত্ৰা করেনি বাডি যাচ্ছে । কথাটা এমন করিয়া শশী ইচ্ছা করিয়া বলে নাই। নিজের কথায় নিজেরই চোখ দুটি তাহাব সজল হইয়া উঠিল। রাস্তাটি চওড়া মন্দ নয়, কিন্তু কঁচা। বর্ষাকালে কোথাও এক হাঁটু কাদা হয়, কোথাও এটেল মাটিতে বিপজ্জনক রকমের পিছল হইয়া থাকে। গোরুর গাড়ির চাকাতেই রাস্তাটির সর্বনাশ কবে সবচেয়ে বেশি। বর্ষার পর কাদা শুকাইলে মনে হয় আগাগোড়া যেন লাঙল দিয়া চষিয়া ফেলা হইয়াছে। শীত পড়িতে পড়িতে পথটি আবার সমতল হইয়া যায় সত্য, কিন্তু লক্ষ লক্ষ ক্ষতের উঁচু সীমানাগুলি গুড়া হইয়া এত ধুলা হয় যে পায়ের পাতা ডুবিয়া যায়। ফালুন চৈত্র মাসে বাতাসে ধুলা উড়িয়া দুপাশের গাছগুলিকে বিবৰ্ণ করিয়া দেয়। গ্রামে ঢুকিবার আগে খালের সঙ্গে সংযুক্ত নালার উপর একটি পুল পড়ে। পুলের নীচে স্রোতের মুখে জাল পাতিয়া নবীন মাঝি সেই অপরাহু হইতে বুক জলে দাঁড়াইয়া আছে।