পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা V8v) কিছু কিছু শাস্তি অনেককেই দিতে পারিত,-গম্ভীর বিষন্ন মুখে পুলিশকে কিন্তু সেই বিদায় করিয়া দিল। তারপর বউ লইয়া সেই যে সে কলিকাতায় গেল,-গাওদিয়ার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখিল না। যাই হোক, নন্দলালের কাছে বিন্দুবাসিনী হয়তো সুখেই আছে। গ্রামের লোক সঠিক খবর রাখে। না। সাত বছরের মধ্যে বিন্দু একবার মাত্র তিন দিনের জন্য বাপের বাডি আসিয়াছিল। গ্রামের ছেলে বুড়ো তখন ঈর্ষার চোখে চাহিযা দেখিয়াছিল,--- অলঙ্কারে অলঙ্কারে বিন্দুর দেহে তিল ধারণের স্থান নাই, একেবাবে যেন বাইক্তি। তবু, হয়তো বিন্দু সুখে নাই! নন্দর তো বয়স হইয়াছে, আরেকটা স্ত্রী তো তাহাব আছে, চরিত্রও সম্ভবত তাহার ভালো নয়। গাওদিয়াবাসী যাহাদের বিবাহিত কন্যাগুলি সারি সারি দাডাইয়া চোখেব জলে ভাসে, তারা ভাবে : হযতো বিন্দু সুখে নাই! ভাবিয়া তাহারা তৃপ্তি পায়। কেহ মুখ ফুটিয়া মনের কথা বলিয়াও ফেলে। গোপাল শুনিতে পাইলে অস্ফুট স্বরে বলে, লক্ষ্মীছাডাব দল। এমনি বাপেক শাসনে শশী মানুষ হইয়াছিল। কলিকাতায় মেডিকেল কলেজে পড়িতে যাওয়ার সময। তাহাব হ্রদব্য ছিল সংকীর্ণ, চিন্তাশক্তি ছিল ভেঁাতা, বসবােধ ছিল স্থল। গ্রাম্য গৃহস্থের স্বকেন্দ্রীয় সংকীর্ণ জীবনযাপনের মোটামুটি একটা ছবিই ছিল ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে তাহার কল্পনার সীমা। কলিকাতায় থাকিবাৰ সময় তাহার অনুভূতির জগতে মার্জনা আনিয়া দেয় বই এবং বন্ধু। বন্ধটির নাম কুমুদ, বাড়ি ববিশালে, লম্বা কালো চেহারা, বেপরোয়া খ্যাপাটে স্বভাব। মাঝে মাঝে কবিতাও কুমুদ লিখিত। কলেজে। সে প্রায়ই যাইত না, হস্টেলে নিজের ঘরে বিছানায় চিত হইয়া শূইয়া যত রাজ্যের ইংরেজি বাংলা নভেল পড়িত, কথকতার মতো হৃদয়গ্রাহী করিয়া ধর্ম, সমাজ, ঈশ্বর ও নারীর (ষোলো সতেরো বছরের বালিকাদের) বিরুদ্ধে যা মনে আসিত বলিয়া যাইত আর টাকা ধার করিত শশীর কাছে। শশী প্রথমে মেয়েদের মতোই কুমুদের প্রেমে পড়িয়া গিয়াছিল ; ওকে টাকা ধার দিতে পারিলে সে যেন বর্তিয়া যাইত। কুমুদ প্রথমে তাহাকে বিশেষ আমল দিত না, কিন্তু অনেক দুঃখ অপমান ও অভিমান চুপচাপ সহ্য করিয়া শশী তাহার অন্তরঙগতা অর্জন করিয়াছিল। সেটা তাহাব অনুকরণ করাব বযস। এই একটিমাত্র বন্ধুর প্রভাবে শশী একেবারে বদলাইয়া গেল। যে দুর্গের মধ্যে গোপাল তাহার মনকে পুরিয়া সিল করিযী দিযাছিল, কুমুদ তাহা একেবারে ভাঙিয়া ফেলিতে পারিল না বটে, কিন্তু অনেকগুলি জানালা দবাজা কাটিয়া দিয়া বাহিরের আলো বাতাস আনিয়া দিল, অন্ধকাবের অন্তরাল হইতে মনকে তাহাব বাহিরের উদারতায় বেড়াইতে যাইতে শিখাইয়া দিলে। প্রথমটা শশী একটু উদভ্ৰান্ত হইয়া গেল। মাথা ঘামাইয়া ঘামাইয়া জীবনকে ফেনাইয়া ফাপাইয়া মানুষ এমন বিবাট ব্যাপার করিয়া তুলিযাছে? জানিবার এত বিষয়, উপভোগ করিবাব এত উপায়, বিজ্ঞান ও কাব্য মিশিয়া এমন জটিল, এমন রসালো মানুষের জীবন ? তাকপর গ্রামে ডাক্তারি করিতে বসিয়া প্রথমে সে যেন হাঁপাইয়া উঠিল। জীবনটা কলিকাতায় যেন বন্ধুর বিবাহের বাজনার মতো বাজিতেছিল, সহসা শুব্ধ হইয়া গিযাছে। এই সব অশিখি, শ, নরনারী, ডোবা পুকুর বন জঙ্গল মাঠ, বাকি জীবনটা তাহাকে এইখানেই কাটাইতে হইবে নাকি? ও ভগৱান, একটা লাইব্রেরি পর্যন্ত যে এখানে নাই! ক্ৰমে ক্ৰমে শশীর মন শাস্ত হইয়াছে। সে তো গ্রামেরই সন্তান, গ্ৰাম্য নরনারীর মধ্যে গ্রামেব মাটি মাখিয়া গ্রামের জলবায়ু শুষিয়া সে বড়ো হইয়াছে হৃদয় ও মনের গড়ন আসলে তাহার গ্রাম্য। শহর তাহার মনে যে ছাপ দিয়াছিল তাহা মুছিবার নয়, কিন্তু সে শুধু ছাপ, দােগা নয়। শহরের অভ্যাস যতটা পারে বজায় রাখিয়া বাকিটা সে বিসর্জন করিতে পারিল, কুমুদ ও বইয়ের কল্যাণে পাওয়া বহু বৃহত্তর আশা-আকাঙ্ক্ষাও ক্ৰমে ক্ৰমে সে চিন্তা ও কল্পনাতে পর্যবসিত করিয়া ফেলিতে পারিল।