পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in NGS *rA মানিক রচনাসমগ্ৰ মনের জোরও তাহার নাই। নিমরাজি হইয়া সে বলিয়াছে, বাড়িতে আর শশীর মত থাকিলে সে আপত্তি করিবে না। শশীর মতামতের প্রশ্নটা তাহারা পছন্দ করে নাই। নিতাই হাসিয়া বলিয়াছে, ছােটােবাবু লোক ভালো। কিন্তু নিজের সমাজে হিতৈষী গণ্যমান্য লোক থাকতে ছোটােবাবুকে মুরব্বি ঠাওরালে পরান ? ঘরের কথায় পরকে ডাকলে ? আর একজন বলিয়াছে, ছোটােবাবু, হরদম আসেন যান, না বটে? এ কথাটা পছন্দ করে নাই পর্যন! দুপক্ষের অপছন্দ শেষ পর্যন্ত কীসে গিয়া ঠেকিত বলা যায় না। কিন্তু হারুর আকস্মিক মৃত্যুর পর পরান বড়ো দমিয়া গিয়াছিল। কলহ না করিয়া বাড়িতে অসুখের ছুতা দিয়া সে উঠিয়া আসিয়াছে। মতির জ্বর কিন্তু কমিয়া গিয়াছে। বর্ষার গোড়ার দিকে তাহাকে ম্যালেরিয়ায় ধরিয়াছিল,—কয়েক দিন ভালো থাকিয়াছে, আবার কঁাপিতে কঁাপিতে পড়িয়াছে জ্বরে। শশীর দামি কুইনাইন জ্বরটা একেবারে ঠেকাইতে পারে নাই। এবার গা ফুড়িয়া কয়েকবার তাহাকে ওষুধ দিয়া শশী আশ্বাস দিয়াছে, আব জ্বর হইবে না। জ্বরে ভূগিয়া মতির বিশেষ ক্ষতি হইয়াছে মনে হয় না। ম্যালেরিয়া ধরিবাব আগে হঠাৎ সে মোটা হইতে আরম্ভ করিয়াছিল। মাঝে মাঝে জ্বরে পডিয়া এটা বন্ধ বইয়া গিয়াছে। মতির সুন্দর গড়নটি চর্বিতে ঢাকিয়া গেলে বড়ো আপশোশের কথা হইত। এখনও প্রতি সপ্তাহে মতিকে শশী একটা করিয়া ইনজেকশন দেয়। সকালে বাডিতে যে কজন রোগী আসে তাদের ব্যবস্থা করিয়া, কালো ব্যাগটি হাতে করিয়া সে যখন হাবু ঘোসেব বাড়ি যায়, হয়তো তখন বেলা হইয়াছে, সমস্ত উঠান ভরিয়া গিয়াছে রোদে। মতির ভীত শুকনো মুখ দেখিয়া শশী হাসিয়া বলে, এতিবার দিলাম। এখনও তোর ভয় গেল না মতি ? কোন হাতে নিবি আজ ? স্পিরিট দিয়া ঘষিলে মতির বাহুতে ময়লা ওঠে। শশী বলে, বড়ো নোংরা তুই মতি,----গায়ে সাবান দিতে পাবিস না ? ইনজেকশন দিয়া শশী দাওয়ায় বসে। পরান বলে, একটা পরামর্শ আছে ছোটােবাবু। বিষয়টা মতির বিবাহ-সংক্ৰান্ত শুনিয়া শশী জাকিয়া বসিয়া একটা বিড়ি ধরায়। ছেলের ইশারায় মোক্ষদা সরিষা আসে কাছে। কুঁচিও আসিয়া ছেলে কোলে কাছে দাঁড়ায়। কুসুমকে দেখিতে না পাইয়া শশী মনে মনে আশ্চর্য হয়। পুবের ভিটার ঘরখানার ছায়া ঘরেব মধ্যেই সংকুচিত হইয়া গিয়াছে। পরানের কথা শুনিতে শুনিতে প্রতি মুহূর্তে শশী আশা করে-পুবেব ওই ঘরের ভিতর হইতে হয়তো দুচোখে গাঢ় স্তিমিত ছায়া সঞ্চয় করিয়া কুসুম হঠাৎ বাহির হইয়া আসিবে-পরমাত্মীয়দের এই সভার এক প্রান্তে দাড়াইয়া থাকিবে পরের মতো। তার সাড়া পাইয়া কুসুম যে কলসিটা তুলিয়া লইয়া ঘাটে চলিয়া গিয়াছিল, শশী তাহা কেমন করিয়া জানিবে? পরানের বক্তব্য শেষ হইয়া আসিলে কুসুম ভিজা কাপড়ে উঠানের রোদে পায়ের দাগ আঁকিয়া পুবের ঘরের ছায়ার মধ্যে ডুবিয়া যায়। রান্নাঘরে পোড়া ডালের গন্ধে চারিদিক ভরিয়া যাওয়ার পরও ঘরে হইতে সে আর বাহির হয় না। মোক্ষদার বৃঢ় বাক্যস্রোতে তারপর কিছুক্ষণের জন্য মতির বিবাহের সমস্যা ভাসিয়া যায়। রান্নাঘরের খোলা দরজা দিয়া অপরাধী ডালের হাঁড়িটা উঠানে আসিয়া আছড়াইয়া পড়িতে আজ যে আবার ও প্রসঙ্গ উঠিবে সে সম্ভাবনা থাকে না। শশী ভাবে, সকলের কাছে কত বকবকিই বউটা না জানি শুনিবে! মোক্ষদা, কুঁচি, মতি সকলেই হইহই করে, ও ঘর হইতে মুমূর্খ পিসি চেঁচায়, কী হল রে বঁচি ? কি হল রে মতি ? চুপ করিয়া থাকে। শশী। সকলকে চুপ করাইতে গিয়া পরান হল্লা আরও বাড়ায়।