পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in V68 মানিক রচনাসমগ্ৰ পারে। তারপর এই জীবনকে ধরিয়া রাখিবার জন্য যামিনীরই আদি ও অকৃত্ৰিম আবিষ্কার মহাকপিলাদি বটিকা সেবন করা বিধেয়। এই বটিকা প্রস্তুত করিতে তিনরাত্রি সময় লাগে। ইহা কখনও প্রস্তুত হইয়া থাকে না। কারণ, তৈরি করিয়া রাখিলে এই মহাতেজস্কর ঔষধের গুণ সূর্যরশ্মি আকর্ষণ করিয়া লয়। সুতরাং যামিনীর মকরধ্বজের তেজে মৃতদেহে জীবন সঞ্চার হইলেও মহাকপিলাদি বটিকার অভাবে প্ৰাণটুকু যে সবসময় টিকিয়া থাকে, এমন নয়। কিন্তু সে অপরাধ কি যামিনীর ? রোগীর কপাল! মহাকপিলাদি বটিকা তৈরি করিতে করিতে মৃত রোগী পুনরায় মরিয়া যাইবে বলিয়া যামিনী তাহাব বিখ্যাত ও বিশিষ্ট মকরধ্বজও ব্যবহার করে না। বলে, লাভ কি হবে বাপু ? মহাকপিলাদি বটিকা তো প্রস্তুত নেই। রোগীকে না হয় বঁাচালাম, তার পর তিনদিন টেকাৰ কী দিয়ে ? মৃতকে যামিনীর এক লহমার জীবন দান কেহ কখনও দ্যাখে নাই। তবু লোকে বিশ্বাস করে। একজন দুজন নয়, অনেকে! যামিনী কবিরাজের বউ কিন্তু কখনও স্বামীর ওষুধ খায় না। অসুখ হইলে এতকাল সে বিনা চিকিৎসাতেই ভালো হইয়াছে। এবার জ্বরে পড়িয়া শশীকে ডাকিয়া পাঠাইল । গোপাল তখন বাড়িতে ছিল। শশীর হইয়া সে বলিযা দিল, বলগে যাচ্ছে,--তারপর শশীকে যাইতে নিষেধ করিয়া দিল । শশী বলিল, কেন, যাব না কেন ? গোপাল বলিল, কবে তোমার বুদ্ধি পাকবে, ভেবে পাই না। শশী । শশীও তাহারা ভাবিযা পায না। সে চুপ করি যা রহিল। তখন গোপাল বলিল, যামিনী খুড়ো অত বড়ো কবরেজ, সে থাকতে ডেকে পাঠানোবা মানেট বোবা ? শশী বলিল, আজ্ঞে না। যুবতি স্ত্রীলোক, নানা বকম কুৎসাও শুনতে পাই--- গোপালের মুখে এই কথা ? লজ্জায় শশী সংকুচিত হইয়া গেল। মৃদুস্বরে সে বলিল, এ সব আপনার বানানো কথা বাবা । গোপাল রাগ করিল না, বলিল, তোমার যে কী হয়েছে আজকাল বুঝতে পারি না। শশী, তোমার ভালোর জন্যে একটা কথা কইলে তুমি আজকাল তর্ক জুড়ে দাও। সংসারে মানুষকে ভেবেচিন্তে কত সাবধানে চলতে হয় সে জ্ঞান তোমার এখনও জন্মেনি। এই তোমার উঠতি পসাবের সময়, এখনই একটা বদনাম রটে গেলে-এও কি তোমায় বলে দিতে হবে? তুমি চিকিৎসার ভার নিলে বলাবলি করবে না লোকে যামিনী কবরেজ থাকতে তুমি ছেলেমানুষ তোমার কেন অতি মাথাব্যথা? সবার বাড়িতে মেয়েছেলে থাকে, এর পর কে আর ডাকবে তোমায় ? শশীর রাগ হইতেছিল। কিন্তু শৈশব ও কৈশোরের এই যমটিকে ভয় করা তাহার সংস্কারে দাঁড়াইয়া গিয়াছে, গোপালের তীক্ষ অপলিক দৃষ্টিপাতে সে চোেখ নামাইয়া লইল। গোপাল আবার বলিল, যামিনী খুড়োর ইচ্ছেও নয় তুমি ওদের বাড়ি যাও। শশীর নীরবতায় গোপাল খুশি হইয়াছে। বয়স্ক উপযুক্ত সন্তানকে বশ করা, জগতে এতবড়ো জয় আর নাই। আজকাল নানা ছোটাে-বড়ো ব্যাপারে শশীর সঙ্গে গোপালের সংঘর্ষ বাধিতেছিল, -কলহ বিবাদ নয়,--তর্ক ও মতান্তর, আদেশ ও অবাধ্যতার বিরোধ। আজ তবে শশী বুঝিতে পারিয়াছে সাংসারিক বুদ্ধিতে বাপের চেয়ে সে ঢের বেশি কাচা, গোপাল এখনও তাঁহাকে পরিচালনা করিতে পারে।