পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in VVS মানিক রচনাসমগ্ৰ মনে মনে শশী ভারী খুশি হইয়াছিল। এতকাল পরে কুমুদের সঙ্গে দেখা হইয়াছে, শুধু এই জন্য নয়। কুমুদ নামিয়া আসিয়াছে বলিয়া। কুমুদের সেই অন্যমনস্ক সরল ঔদ্ধত্য নাই, নিজেকে সংসারের আর সকলের চেয়ে স্বতন্ত্র, সকলের চেয়ে বড়ো মনে করিতে সে ভুলিয়া গিযাছে। এটুকু শশী প্রথম হইতেই টের পাইতেছিল। কুমুদের কাছে নিজেকে তাহার চিরদিন ছোটাে মনে হইয়াছে, তুচ্ছ মনে হইয়াছে। কুমুদের অন্যায়ের ইতিহাসগুলি শুনিয়া পর্যন্ত ঈর্ষার সঙ্গে তাহার মনে হইযাছে এত সাহস এত মনের জোর এতখানি তেজ তাহার নাই, এ রকম অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অভাবে জীবনটাই বৃথা গেল তাহার। আজ কুমুদের মৃদু অস্বস্তি, চেষ্টা করা সহজ ব্যবহার এবং একেবারে যাত্রার দলে অধঃপতন তাহাকে যেন শশীর চেয়েও নীচে নামাইয়া দিয়াছে। বন্ধুকে আর শশীর গুরুজন গুরুজন মনে হইতেছে না। কুমুদ বলিল, তোর ঘরখানা বেশ সাজানো। গ্রামে থেকে গেয়ো বনে যাসনি দেখছি।--সে আবার একটু হাসিল, তাহার পূর্বের হাসির সঙ্গে তুলনা করিয়া এ হাসিকে শশীর মনে হইল ভীর, অপরাধী হাসি-কতকাল ধরে কারও বাড়িতে ঢুকিনি জানিস শশী ? চার বছর। পাবিবারিক আবহাওয়াটা মুগ্ধ করে দিচ্ছে। বিয়ে করেছিস ? না করিাসনি ? তোর ঘর দেখে মনে হচ্ছিল বউ আছে। ঘব কে গুছিয়েছে বে, বোন ? উঠানে যাকে দেখলাম ? ও বোন নয়। ভাগনি-পিসির মেয়ের মেয়ে। বোন একটা আছে, ছোটো, আট বছর বয়স, গোছানোর বদলে বরং নোংরাই করে দিয়ে যায়। আমার খাটের তলাটা হল ওর খেলাঘর। তাকিয়ে দাখ, পুতুলেরা সার সার ঘুমোচ্ছে। এইবার ঘুম ভাঙবে-খুকির আসার সময় হল। একটু চেষ্টা করে ভাবি জমাস, ভারী চালাক মেয়ে, ভারী বুদ্ধি। পড়াচ্ছি। কিনা, আমি জানি। চটপট শিখছে। সামনের বছর স্কুলে ভর্তি করে দেব। শশী চিন্তিত হইয়া মাথা নাড়ে, দেব বলছি,-হবে কিনা ভগবান জানেন। বাবার এ সব পছন্দ নয়। হয়তো বলবেন, ছেলে লেখাপড়া শিখে হয়েছে অবাধ্য, মেয়ে কী হবেন ঠিক কী? স্কুলেটুলে দিয়ে কাজ নেই বাপু—শেখা না, বাড়িতেই শেখা! কুমুদ শশীর মুখের ভাব লক্ষ করিতেছিল, বলিল, বুঝিযে দিস আজকাল মেয়েদের স্কুলে না। निल छब्ल ना। বুঝিয়ে ? বাবাকে ? বাবা সেকেলে মানুষ। কথা বদলাইয়া বলিল, ঘর কে গোছায় বলছিলি? লোকের অভাব কী ! এ হল বাংলাদেশ, একজন রোজগার করে, দশজনে খায়। ঘর গোছাবার লোকের অভাব নেই। তবে-বন্ধুকে শশী চোখ ঠারিল, নিজের ঘর আমি নিজেই গোছাই। শশীকে যামিনী কবিরাজের বউয়ের কাছে। যাইতে হইবে। এ কর্তব্য অবহেলা করিবার উপায ছিল না। বন্ধুকে খাইয়ের মোয়া আর চন্দ্রপুলি খাওয়াইয়া শশী বিদায় লইল। গ্রামে পর্দা-প্রথা শিথিল কিন্তু সে গ্রামেরই চেনা মানুষের জন্য। শশীর বাড়ির মেয়েরা সকাল বেলা অন্তঃপুরে পাক খায়। কুমুদ উৎসুক দৃষ্টিতে খোলা দরজা দিয়া প্ৰকাণ্ড সংসারটির গতিবিধি যতটা পারে দেখিতেছিল, খানিক পরে ছোটাে একটি ছেলে আসিয়া দরজাটা ভেজাইয়া দিয়া গেল। কুমুদ আহত হইয়া ভাবিল, আমি তো ওদের দেখিনি ? ওদের কাজ দেখছিলাম যে আমি। সকলে মিলে কী রচনা করছে তাই দেখছিলাম। জামাটি গায়ে দিয়া কুমুদ বেড়াইতে বাহির হইয়া গেল। একটি পরিবারের গোপন মর্ম-স্পন্দন দেখিয়া ফেলার অপরাধ একা এক অন্তঃপুরের একটা ঘরে বসিয়া সহ্য করা কঠিন।