পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা 8O (፩ বড়ো ভাই, কুমুদের গুরুজন,-কিন্তু আগাগোড়া কী উদ্ধত অপমানজনক ব্যবহার কুমুদ তার সঙ্গে করিয়া গিয়াছে! শশীও এটা লক্ষ করিয়াছিল। রাগ তাহার কম হয় নাই। মতিকে যদি কুমুদ বিবাহ করিতে পারে, মতির দাদাকে সম্মান করিতে পরিবে না? কিন্তু মুখে সে কিছুই বলে নাই কুমুদকে। শুধু তাব সামনে পরানেব সঙ্গে কবিয়াছিল প্রীতি ও শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার,-কুমুদ যাতে দেখিয়া শিখিতে পারে। শশীর এ চেষ্টাব বিশেষ কিছু ফল হয় নাই। মতির আত্মীয়-পরিজনের প্রতি অসীম অবজ্ঞা দেখাইয়া মতিকে কুমুদ গ্রহণ করিয়াছিল। মাঠে পাবানের খেজুর রস জ্বাল হইতেছে। দুপুরে ছাড়া শশীর সময় হয় না বলিয়া পরান দেড় মাইল পথ হাঁটিয়া আসিয়া কাজের ক্ষতি করিযী শশীর কাছে বসিয়া থাকে। চওড়া সবল কঁধ দুটি যেন তাহার শ্রান্তিতে ঢালু হইয়া আসে। বলে, পত্র দেয় না কেন ছোটােবাবু? শশী অপরাধীর মতো বলে, কী জােন পরান, চিঠিপত্র লেখা কুমুদের অভ্যাস নেই। কলেজে পড়বার সময় ওর বাবা হােস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টকে লিখে ওর খবর নিতেন। তাই বলে একবারটি জানাবে না কোথায় গেল, কোথায় উঠল, কী বিত্তান্ত? মা ইদিকে কঁদোকাটা জুডেছে। কুমুদকে মনে মনে অভিশাপ দিয়া শশী বলে, আসবে পরান, পত্র আসবে। খবর না দিয়া কি পারে? আজি হেশ কাল হোক খবর একটা দেবেই। পরান কেমন এক প্রকার স্তিমিত বিষন্ন দৃষ্টিতে শশীর দিকে চাহিয়া থাকে। নীরবে সে যেন কীসের নালিশ জানায়, মুক প্রাণীর মতো। শশীর অস্বস্তির সীমা থাকে না। হারু ঘোষের পরিবারের ভালোমন্দের দায়িত্ব শশীকে কেহ দেয় নাই, তবু চিরদিন ওদের মঙ্গল করিতে চাহিয়াছে বলিয়া আপন হইতে দাযিত্ব যেন তাহাব জন্মিযাছে। কিন্তু কী মঙ্গল সে করিতে পারিয়াছে ওদের ? তবে দোষ নাই, তবু তাবই জন্য কুসুম যেন কেমন হইয়া গেল। একটা খাপছাড়া বিপজ্জনক বিবাহ হইল। মতির। হয়তো পরান আজ এ সব হিসেব করিয়া দেখিতেছে হয়তো তাদের অসমান বন্ধুত্বেব ফলাফলে বিচলিত হইয়া উঠিযাছে পরান, --ভীত হইয়া ভাবিতেছে ভালো করিতে চাহিয়া আবও না জানি কত শশী জানে, মুখ ফুটিয়া পরান কোনো বিষয়ে তাহাকে দোষী করিবে না,-শুধু বিষন্ন চিন্তিত মুখে দুর্বোধ্য-রহস্য-দ্ৰষ্টা শিশুর মতো তার দিকে চাহিযা থাকিবে। দীর্ঘদেহ নির্ভরশীল সরল লোকটির জন্য শশীর মন মমতায় ভরিযা যায়। ভাবে যেমন করিয়াই হোক মতিকে সুখী করিতে কুমুদকে সে বাধ্য কবিবে। মতি বদলাক, মতিকে কুমুদ যেমন খুশি গড়িয়া তুলুক।--তার মুখে চোখে উপচানো সুখের সঙ্গে পাবানের পরিচয ঘটা চাই। শুধু মতির জন্য নয়, নানা দিকে শশীর চিন্তা বাড়িয়াছে। তার মধ্যে বিন্দুর সম্বন্ধে চিন্তাটা গুরুতর। দিন দিন বিন্দু যেন কেমন হইয়া যাইতেছে ভুলিয়া থাকিতে পাবিবে বলিয়া প্রকাণ্ড সংসাবটা চালানোর ভার শশী মাসি-পিসির কবল হইতে ছিনাইয়া বিন্দুর হাতে তুলিযা দিয়াছিল। বিন্দু জীবনে কখনও সংসার পরিচালনা করে নাই। সে কেন এ ভার বহন । বিতে পরিবে? তাছাড়া বিন্দুর ভালোও লাগে নাই। সব ভার সে আবাব একে একে মাসি-পিসিকে ফিরাইয়া দিয়াছে। কাজ করিতে বিন্দুর আলস্য বোধ হয়। মানুষের সঙ্গ তাহার ভালো লাগে না। কথাবার্তা কারও সঙ্গেই সে বেশি বলে না, নিজের মনে চুপচাপ ঘরের কোণে বসিয়া থাকে। বসিয়া বসিয়া ঝিমায়। কত কাল অনবরত রাত জাগিয়া জাগিয়া সে যেন নিদ্রাতুরা হইয়া আছে এমনই ভাবে সর্বদা হাই তোলে। অথচ ঘুমায় সে খুব কম। কিছু সে খাইতে চায় না, দিন দিন শুকাইয়া যাইতেছে। আধমরা মানুষের মতো শিথিল নিস্তেজ ভঙ্গিতে সে দীর্ঘ দিবারাত্রি যাপন করে ।