পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8Oや2 মানিক রচনাসমগ্র শশী ডাক্তার মানুষ, বিন্দুকে নিজের ঘরে ডাকিয়া লইয়া সে জিভ দ্যাখে, হার্ট পরীক্ষা করে, শরীরের অবস্থা সম্বন্ধে জেরা করে। তারপর সন্দিগ্ধভাবে মাথা নাড়িয়া বলে, কিছু বুঝতে পারলাম না বাপু ! গাঁয়ের ডাক্তার, পেটে তো বিদ্যে নেই তেমন! একটা ওষুধ দিচ্ছি। কদিন খা, তারপর আবার পরীক্ষা করে দেখব । বিন্দু বলে, উকু ওষুধ আমি খাব না! শশী বলে, খাবি। মুখ দিয়ে না খাস, গা ফুড়ে দেব। বাপের বাড়ি এসে তুই যদি মরে যাস বিন্দু আমি থাকতে, আমার তাতে কী অপমান হবে বল দিকি ? বিন্দু কঁাদিয়া ফালে। কঁদিতে কঁাদিতেই বলে, কী করব দাদা, মনে বল পাই না, দিনরাত কুহু করে জ্বলে, মনের মধ্যে। শশী বলে, কঁদিস না। আমার ওষুধ খেলেই মন ভালো হয়ে যাবে! বিন্দুর বেগ-নির্ণয় কবা শশীর অসাধা মনে হয়। মনের মধ্যে দিন রাত তুহু করিয়া জ্বলে? কাব্য জন্য জ্বলে, কেন ? জীবনটা ব্যর্থ হইয়া গেল বলিযা মানুষ কি শোকে এমন নিজীব মৃতপ্রায় হইয়া যায়। নন্দর প্রতি তীব্র বিদ্বেষই তো বিন্দুকে দুদিনে সুস্থ ও সবল করিয়া তোলাব পক্ষে যথেষ্ট। বিদ্বেষ যদি নাও হয়, আকাশ-ছোঁয়া অভিমান বিন্দুকে নব-জীবন দিতেছে না কেন? নন্দ ক্ষমা করিবে এই আশায অতগুলি বছর বিন্দু যে অবস্থায় কাটাইয়া আসিয়াছে তাহাতে আজ যদি নন্দর জন্যই বিন্দুর মন হাহাকার করে শশী তাহাতে বিস্মিত হইবে না। সংসারে এ রকম অদ্ভুত মেয়ে দু-চারটা থাকে। কিন্তু নন্দব জন্য মন কেমন করিলে বিন্দুর তো উচিত অস্থির চঞ্চল হইয়া থাকা, কাজ ও অকাজের ভানে ছটফট করা। এমন সে অলস ও অবসন্ন হইয়া আসিবে কেন—তৈলহীন প্ৰদীপের মতো কেন সে নিভিয়া যাইতে থাকিবে ? একদিন বিন্দু বলিল, দাদা আলমারির চাবি দাও। বই নেব। শশী বলিল, বাংলা বই তো বেশি নেই। আলমারিতে। বই যদি পড়িস তো আনিয়ে দেব শহব থেকে । আলমারিতে যা আছে তাই তো এখন পড়ি, শহর থেকে যখন আনিয়ে দেবে দিয়ো । শশী চাবির গোছােটা তাহার হাতে দিল। আলমারি খুলিয়া একখানা বই বাহির করিয়া আবার বিন্দু আলমারি বন্ধ করিল বটে, চাবি ফেরত দিল না। বলিল, চাবি আমাব কাছে থাক। তুমি তো বেড়াও রোগী দেখে, আরেকটা বই বার করতে হলে সারাদিন হয়তো তোমার দেখাই পাব না। শশী বলিল, গোছাসুদ্ধ রেখে কী করবি? বইয়ের আলমারির চাবিটা খুলে নে। বিন্দু বলিল, থাক না গোছাসুদ্ধই—ইচ্ছে হলে তোমার ব্যাকসো-প্যাটরা ঘেঁটেও তো সময় কাটাতে পারব। দুদণ্ড ? বাড়ি ছেড়ে কোথাও তো যাব না। আমি, চাবির দরকার হলে আমায় ডেকো। এমন সহজভাবে সে কথাগুলি বলিল যে শশীর মনে কোনো সন্দেহ আসিল না। হয়তো অন্যমনস্ক ছিল বলিয়াও শশীর মনে পড়িল না ওষুধের আলমারিতে চার-পাঁচটা শিশির গায়ে লাল অক্ষরে বিষ লেখা আছে। বিন্দুকে সে যে কত দিন উৎসুক লোভাতুর দৃষ্টিতে ওষুধের আলমারির দিকে চাহিয়া থাকিতে দেখিয়াছে খেয়াল করিলে তাও হয়তো শশীর মনে পড়িত। সেদিন বিকালে মাইল পাঁচেক দূরে একটা গ্রামে শশী রোগী দেখিতে গিয়াছিল। গ্রামে ফিরিতে রাত প্ৰায় নটা হইয়া গেল। বাড়ির সামনে পৌঁছিয়াই অন্দরে একটা গোলমাল শশীর কানে আসিল। বাহিরের ঘরগুলি অন্ধকার, জনপ্রাণী নাই। কেবল সিন্ধু এক অন্ধকারে দাঁড়াইয়া মৃদুস্বরে কঁদিতেছে। শশী ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে রে সিন্ধু ? সিন্ধু কঁাদিতে বলিল, মেজদি মরে যাচ্ছে দাদা।