পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8○br মানিক রচনাসমগ্র রহিল, বিন্দু ঘরে খিল দিয়াছিল, সেও কোনো সাড়াশব্দ দিল না। সমস্ত সকালটা বাড়ি তোলপাড় করিয়া, একজন মুনিষকে খড়ম দিয়া পিটাইয়া, জামা চাদর লইয়া ছাতা বগলে গোপাল বাহির হইয়া গেল। বলিয়া গেল, কলিকাতা যাইতেছে, কারণ গ্রামে তাহার মুখ দেখাইবার উপায় নাই। ফিরিযা আসিয়া বিন্দুকে যদি গৃহে দেখিতে পায় বাড়িঘরে গোপাল আগুন ধরাইয়া দিবে। মেজাজটা শশীরও বিগড়াইয়া গিয়াছিল। বিন্দুর উপরে কিন্তু তাহার বাগ হইল না। দিন তিনেক বিন্দু ঘরেব বাহিবে আসিল না,--দিবারাত্রি খিল দিয়া ঘরেব মধ্যে নিজেকে নির্বাসিত করিয়া রাখিল। শুধু শশীর ডাকাডাকিতে বাহিবে আসিযা পুকুরে একটা ডুব দিয়া আসে, ঘাড গুজিয়া দুটি ভাত মুখে দেয়, তাবপর আবাব ঘরে গিয়া খিল বন্ধ করে। কেহ কথা বলিলে জবাবও দেয় না, মুখও তোলে না। তিনদিন পরে কী মনে কবিয়া সে ঘরের বাহিরে আসিল,—কুন্দর সঙ্গে সহজভাবে দুটি একটি কথাও বলিল। কিন্তু মিশিতে পারিল না। কারও সঙ্গে। এখানে আসিয়া অবধি যে রকম নিজীব নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করিতেছিল। তেমনি ভাবে দিন কাটিতে লাগিল। একটা অনাবশ্যক ব্যস্ততার সঙ্গে শশী ঘুরিয়া বেড়ায়, কর্তব্য কাজগুলি সম্পন্ন কবে। এতদিন সে বোগীর পরিবাবের আত্মীয-বন্ধুব মতো রোগী দেখিয়াছে, ওষুধের সঙ্গে দিয়াছে আশ্বাস। এখন সে গম্ভীর মুখে রোগীর নাড়ি টেপে, সামান্য কারণে রাগিয়া আগুন হইয়া ওঠে। কোনো কথা একবারের বেশি দুবার বলিতে হইলে বিরক্তিব তাহার সীমা থাকে না। সময়টা চৈত্র মাস। কড়া রোদে মাঠ ভাঙিয়া শশীর পালকি গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে যায়, তুহু করিয়া গরম বাতাস বহিতে থাকে। পালকির মধ্যে নিস্ক্রিয় উত্তপ্ত অবসর শশী ভাবিয়া ভাবিয়া ক্ষয় কবিয়া ফেলে। বিন্দুর কথা ভাবে, কুসুম ও মতির কথা ভাবে। কুসুম ও মতির সম্বন্ধে নূতন করিয়া কিছু ভাবিবার নাই। বিন্দুর কথা ভাবিয়া সে কুল-কিনারা দেখিতে পায় না। বিন্দুকে সেই নন্দর কবল হইতে ছিনাইযা আনি যাছে,-ওর সম্বন্ধে সমস্ত দায়িত্ব তাহার। বিন্দু যে বীভৎস কীর্তি কবিয়া লোক হাসাইয়াছে, গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে অকথ্য দুর্নােম রটনা হইতেছে, এ জন্য শশী নিজেকে অপরাধী মনে করে। তবেই দোষ। যে বিষযে সে দায়িত্ব গ্রহণ করে তাই ভ্যাস্তইয়া যায়। একটা অদৃশ্য দূর্লার শক্তি যেন আহবাহ তাৰ বিবুদ্ধে কাজ করিতেছে। বৃপসি সেনদিদিব স্নেহ প্ৰিয ছিল, কুবৃপা সেনদিদিকে এডাইয়া চলিবার ইচ্ছার জন্য তাই নিজেকে আজ অশ্রদ্ধা করিতে হয়!! অবস্থা পড়িয়া গিয়াছে বলিয়া মমতাপ বশে পরামর্শ দিয! সাহায্য কবিয হাবু ঘোষের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করিয়াছিল। তারপর যে দিন আপন! হইতে ওদের অভিভাবকের আসনটি সে পাইয়াছে, সেদিন চিনিতে পাবিয়াছে কুসুমেব মন, নষ্ট করিয়াছে মতির ভবিষ্যৎ । এবাব বিন্দুর এই অবস্থা দাঁড়াইল। বিন্দুকে আনিবার সময় কত কল্পনাই সে করিয়াছিল!-- ধীরে ধীবে বিন্দুর মনকে সুস্থ করিয়া তুলিবে, গ্রামেব শান্ত আবেষ্টনীতে মনে ওর শান্তি আসিবে, তার স্নেহ যত্ন সাহচর্যে স্বামীহীনা নারীর যত রস ও আনন্দ জীবনে থাকা সম্ভব ক্ৰমে ক্ৰমে সব আসিবে বিন্দুর জীবনে ; বই পড়িতে এবং ভাবিতে শিখাইয়া একটি অপূর্ব অন্তর্লোেক ওর জন্য সে সৃষ্টি করিয়া দিবে। তা যে কতদূর অসম্ভব আজ আর বুঝিতে শশীর दाकि मां । ভাবিতে শশীর কষ্ট হয, তবু ইহা সত্য যে শুধু নেশার জন্যই বিন্দু সেদিন মদ খাইয়াছিল, আর কোনো কাবণে নয়। একদিন হয়তো সাড়াশি দিয়া দাঁত ফ্ৰাক করি যা তাহাকে নন্দর ও জিনিসটা গিলাইতে হইয়াছিল,-“আজি মদ ছাড়া বিন্দুর চলে না। তা ছাড়া, শুধু মদের নেশা নয়, সাত বছর ধরিয়া নন্দ তাহাকে যে উত্তেজনাময় অস্বাভাবিক জীবন দিয়াছিল, সেই জীবনও বিন্দুর অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে। তাহার বিপুল বিকারগ্রস্ত বিরহ তো শুধু নন্দর জন্য নয়,-লজ্জাকর বিলাসিতার জন্য, সংগীত ও উন্মত্ততার জন্য। গ্রামের বৈচিত্র্যহীন স্তিমিত নিস্তেজ জীবন বিন্দুর সহিতেছে না।