পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8 br মানিক রচনাসমগ্ৰ যাদব গভীর মুখে বলেন, সূর্যকে। সূর্যবিজ্ঞান বিশ্বাস কর না। তাই অবাক হও, নইলে এ তো তুচ্ছ! সূর্যবিজ্ঞান যে জানে তার উপবীত কখনও ময়লা হতে পারে? কী করি জান ? স্নান করে উঠে রোজ একবার রোদে মেলে ধরি, ধবধবে সাদা হয়ে যায়। আজ খানিকটা বাদ পড়েছিল, কেমন ময়লা হয়ে আছে দ্যাখে যাদব পইতা মেলিয়া ধরেন, শশী লক্ষ করিয়া দ্যাখে রোদের পাশে ছায়ার মতো পইতার খানিকটা সত্যসত্যই নিম্প্রভ, মলিন। সূর্যবিজ্ঞানে আর নিজের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতায় শশীর বিশ্বাস জন্মানোর জন্য কত যত্নে না জানি যাদব পইতার এই অংশটুকু পাতলা জল-মেশানো কালিতে ডুবাইয়াছেন, কালি যাতে বুঝা না যায়! শশীর হাসিও পায়, মায়াও হয়। তাকে অভিভূত করার জন্য এত ব্যাকুল প্ৰয়াস কোন যাদবের ? অলৌকিক শক্তিতে অবিশ্বাস করিলেও যাদবকে শ্রদ্ধা সে (তা কম করে না ! যাদব বলেন, কত বললাম, শেখো, শশী শেখো, সূর্যবিজ্ঞানের ভূমিকাটুকু অন্তত শেখো, ওষুধেব বাকসো ঘাড়ে করে আর রোগী দেখে বেড়াতে হবে না। তা তো শিখলে না। যে বিজ্ঞানের ভিত্তিই মিথ্যে তাই নিয়ে মেতে রইলো। যাকে তাকে দেবার বিদ্যা এ তো নয়, সারা জীবনে একটি শিষ্য পেলাম না যাকে শিখিয়ে যেতে পারি। এদিকে সময় হয়ে এল যাবার। শুধু তুমি একটু শিখতে পার শশী, সবটা নয়, সবটা নেবার ক্ষমতা তোমারও নেই, শুধু ভূমিকাটুকু। তাই বা কজনে পায় ? কায়মনোবাক্যে আজও তুমি ব্ৰহ্মচারী বলে বিব্রত, বিস্মিত শশী শুনিয়া যায়। এ ধরনের কথা যাদব মাঝে মাঝে বলেন, শশী সায়ও দেয় না, প্রতিবাদও করে না। যাদবের শান্ত ধূপগন্ধী ঘরে সে দুদণ্ডের জন্য জুড়াইতে আসে, তাকে এ সব অবিশ্বাস্য কাহিনি শোনানো কেন ? সে কি শ্ৰীনাথ মুদি যে শুনিতে শুনিতে গদগদ হইয়া মুখে ফেনা তুলিবে? শশীর অবিশ্বাস যাদব টের পান। শশীকে জয় করিবার জন্য তার এত বেশি আগ্রহের কারণও বোধ হয় তাই। বলেন, সূর্যবিজ্ঞান যে জানে, তার অসাধ্য কী? অতীত ভবিষ্যৎ তার নখদর্পণে। কবে কী ঘটবে জীবনে কিছুই তার অজানা থাকে না। মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত দশ-বিশ বছর আগে থেকে জেনে রাখতে পাবে। পইতাটা যাদব আঙুলে জড়ান। আর খোলেন। দুচোখ জ্বলজ্বল করে। সাধে কি ভীরু গ্রামবাসী ভয় করে যাদবকে ! এমন জ্যোতিষ্মান চোখে চাহিয়া এমন জোরের সঙ্গে যাই তিনি বলুন, অবিশ্বাস করিবার সাহস কারও হওয়া সম্ভব নয়। আপনি জানেন ?-শশী জিজ্ঞাসা করে। জানি না ? বিশ বছর থেকে জানি। --বলেন যাদব। হাসি পায় বলিয়া শশী ফস করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া বসে, কবে ? যাদবও সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন, রথের দিন। আমি রথের দিন মরবি শশী। কবে কোন সালের রথের দিন যাদব দেহত্যাগ করবেন ঠিক হইয়া আছে, শশী আর সে কথা জিজ্ঞাসা করে না, কারণ কথাটা বলিয়াই যাদব হঠাৎ এমন ভীতভাবে স্তব্ধ হইয়া যান এবং পাগলদিদি এমনভাবে অস্ফুট একটা শব্দ করিয়া ওঠেন যে শশী লজা বোধ করে। অবিশ্বাসের পীড়নে উত্তেজিত করিয়া এমন অসাবধানে যাদবকে ও কথা বলানো তাহার উচিত হয় নাই। আর ছমাস এক বছরের বেশি গ্রামে শশী থাকিবে না। এ কথা যাদব জানেন। তবু, তার মধ্যেই অসুখ-বিসুখ হইয়া যদি তিনি মরিতে বসেন আর শশীকেই তার চিকিৎসা করিতে আসিতে হয়, মরিতে বেচারির সুখ থাকিবে না!