পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা 8、企 পাগলদিদি বলিলেন, তীর্থে যাবার কথা তো বলে এলি ভাই, গিয়ে কী হবে? দল বেঁধে গায়ের লােক সঙ্গে যাবে। এত লােক দিনরাত পাহারা দিচ্ছে, সকলের নজর এড়িয়ে পালাবাে কোথা? একটু যেন গা-ছাড়া দিয়া উঠিয়াছেন পাগলদিদি, কোনো দিকে আশার আলো দেখিতে পাইয়াছেন কিনা কে জানে! মুখখানা খুব বিষগ্ন কিন্তু শান্ত, ভয় ও উদবেগের ছাপটা মুছিয়া গিয়াছে। চলিতে চলিতে বলিলেন, পালিয়ে গিয়েই বা কী হবে বল ? কি বছর বা আর বঁচিব। বিদেশে নতুন লোকের মধ্যে কত কষ্ট হবে, মনে একটা আপশোশ থাকবে। অমন করে দুটাে একটা বছর বেশি বেঁচে থেকে সুখটা কী হবে, তাই ভাবি। তার চেয়ে এ ভাবে যাওয়া ঢের বেশি গৌরবের। শশী বলিল, কিন্তু নিজের ইচ্ছায় যখন খুশি কেউ কি যেতে পারে দিদি ? ও যে সিদ্ধি লাভ করেছে রে পাগল! ওর অসাধ্য কিছু আছে? পাগলদিদি বোধ হয় লুকাইয়া আসিয়াছিলেন, তাহাকে দেখিবামাত্র একদল নরনারী আসিয়া ছকিয়া ধরিল। শশীর সঙেগ অতি কষ্টে বাড়িতে ঢুকিয়া তিনি দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। ভিড় পাগলদিদির সহ্য হয না। র্তাহাকে দেখিবার জন্যও জনতা চেঁচামেচি করে কিন্তু তিনি কখনও বাহিরে আসেন না। তেল সিঁদুব হাতে করিয়া মেয়েরা তাহার বুদ্ধ দরজার সম্মুখ হইতে ফিরিয়া যায়। যাদব ভিতরে আসিয়া বলিলেন, শশী এসেছ? সেদিন একটু বকেছিলাম বলে রাগ করে কদিন আব্ব দেপাশ দিলে না ভাই ? তোমার কথা ভাবছিলাম শশী। কত ক্ষতি করে গিয়েছিলে সেদিন, তোমার সে ধাৰণা নেই, মায়ার বশে কুপবামর্শ দিয়ে গেলে, থেকে থেকে কথাটা বিমনা করে দিয়েছে। সহজে তুচ্ছ তো করতে পারি না তোমার কথা! অনেক কথা বলেন যাদব। তিনি তো চলিলেন, পাগলদিদিকে শশী যেন দেখাশোনা করে। এতকাল অসুখ-বিসুখ হইলে সূর্যবিজ্ঞানের জোরে আরোগ্য তিনিই করিয়াছেন, এবার হয়তো শশীর ওষুধ খাইতে হইবে।--শিখলে পারতে শশী সূর্যবিজ্ঞান। বামুনের ছেলে নও, মন্ত্রশিষ্য তোমাকে করতে পাবি না, বিদেটিা শিখিয়ে দিতে পারতাম। শিখবে ? যাদব হাসিলেন।--আর তো শেখাবার সময নেই শশী! বথেব দুদিন আগে খুব বৃষ্টি হইয়া গিযাছিল, সেদিনও সকালের দিকে কখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়িল, কখনও মেঘলা করিয়া রহিল। আগের দিন সন্ধ্যা হইতে সংকীর্তন আবম্ভ হইয়াছিল, সারাবাত্রি এক মুহুর্ত বিরাম হয় নাই। সকালবেলা নূতন নূতন লোক আসিয়া দল ভারী করিয়াছে, কীর্তন আরও জাকিয়া উঠিয়াছে। যাদব স্নান করিয়া পট্টবস্ত্র পরিধান করিয়াছেন, সকলে ফুলের মালায় তাহাকে সাজাইয়াছে। পাগলদিদিও আজ রেহাই পান নাই, তার গলাতেও উঠিয়াছে অনেকগুলি ফুলের মালা। তবে তেল সিঁদুর দেওয়া সধবারা বন্ধ করিয়াছে। আজ যার বৈধব্যযোগ তাকে ও সব আর দেওয়া যায় না। বেলা বাড়িবার সঙ্গে যাদবের বাড়ির সামনে আর কায়েতপাড়ার পথে লোকে লোকারণ্য হইয়া উঠিল। গাওদিয়া, সাতগাঁ আর উখারা গ্রামের একদল ছেলে ভলান্টিয়ার হইয়া কাজ করিতেছে, উৎসাহ তাদেরই বেশি। বাঁশ বঁধিয়া দর্শনার্থী মেয়ে-পুরুষের পথ পৃথক করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ভাঙা দাওয়ায় যাদবের বসিবার আসন । অঙ্গনে কয়েকটা চৌকি ফেলিয়া গ্রামের মাতকবরেরা বসিয়াছেন। তাদের কুঁকা টানা ও আলাপ-আলোচনার ভঙ্গি উৎসব বাড়ির মতে,-যেন বিবাহ উপনয়ন সম্পন্ন করাইতে আসিয়াছেন। শীতলবাবু ও বিমলবাবুসকালে একবার আসিয়াছিলেন, দুপুরে আবার আসিলেন। বাবুদের বাড়ির মেয়েরা আসিলেন অপরাহ্রে। যাদব এবং পাগলদিদির তখন মুমূর্ষ অবস্থা। শশী আগাগোড়া দুজনকে লক্ষ করিয়াছিল। বেলা এগারোটার পর হইতে দুজনেই ধীরে ধীরে নিস্তেজ ও নিদ্রাতুর হইয়া আসিতেছেন দেখিয়া মনের মধ্যে তাহার আরম্ভ হইয়াছিল তোলপাড়। আরও খানিকক্ষণ পরে শশীর দিকে ঢুলু ঢুলু চােখ মেলিয়া একবার মাত্র চাহিয়া যাদব এক অদ্ভুত