পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8O মানিক রচনাসমগ্ৰ রামতারণের বয়স হইয়াছে। আদালতে যাওয়া তিনি অনেক কমাইয়া ফেলিয়াছেন। ভোর চারটেয় উঠিয়া আহ্নিক করিতে বসেন,--মানুষটা ধাৰ্মিক। বলিলেন, স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করবেন। এ রকম একটা খবর কানে এসেছিল, গুজব বলে বিস্বাস করিনি। নইলে একবার দেখতে যেতাম। এখন আপশোশ হয়। কতবার পায়ের ধুলো দিয়েছেন, এত বড়ো মহাপুরুষ ছিলেন জানলে পরকালের কিছু কাজ করে নিতাম। এসেছেন গিয়েছেন, টেরও পাইনি কী জিনিস ছিল তার মধ্যে। শশী বলিল, অনেকে সিদ্ধপুরুষ বলত। তাই ছিলেন। এমন আত্মগোপন করে থাকতেন, বুঝবার কোনো উপায় ছিল না। আগে যদি अन52 ! অনেক কথা হয়, অনেক আলোচনা, অনেক পরামর্শ। রামতারণের ছেলে, জামাই, মুহুরি, আমলারা চারিদিকে ঘিরিয়া আসিয়া স্তব্ধ বিস্ময়ে শশীর কথা শুনিয়া যায়। যাদবের দেহত্যাগেব বর্ণনা শুনিতে শুনিতে রামতারণ আবেগের সঙ্গে বলেন, মরছে। সবাই, অমন মরণ হয় কি জনের ? অসুখ নেই বিসুখ নেই, ইচ্ছা হল আর দেহ ছেড়ে আত্মা অনন্তে মিশিয়ে গেল।—তোমাব ডাক্তাবি শাস্ত্ৰে একে কী বলে শশী ? কী বলবে? কিছুই বলে না। রামতারণ আরও আবেগের সঙ্গে বলেন, কোথেকে বলবে? ভারতবর্ষ ছাড়া জগতের কোথায আছে এ জ্ঞান ? ভাবলেও গায়ে কঁাটা দিয়ে ওঠে। দুপাতা ইংরেজি পড়ে। এ সব আমরা অবিশ্বাস করি, ফাকি বলে উড়িয়ে দিই-কই এবার বলুক দেখি কেউ কোথায় এতটুকু ফঁাকি ছিল ? নিজে তুমি ডাক্তার মানুষ, আগাগোড়া দাঁড়িয়ে সব দেখেছি। দাও শশী, সমস্ত বিবরণটা লিখে কাগজে ছাপিয়ে দাও, পড়ে মতিগতি একটু ফিারুক মানুষের। অল্পবয়স হইতে এ বাড়িতে শশীর আনাগোনা আছে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করিযা এখানেই সে বিশ্রাম করিল। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে শহরে আসিয়া যাদব শেষ উইল করিয়া গিয়াছিলেন। প্রাণ ও মান বাঁচানোর জন্য পালানোর পরামর্শ দিয়া যেদিন শশী তার বকুনি শুনিয়াছিল, তারও পরে। মরিবার জন্য যাদব হয়তো সেই সময়েই মনস্থির করিয়াছিলেন, তার আগে বোধ হয় নয়। শশী আজি সব বুঝিতে পারে। যে রকম অপূর্ব ও লোভনীয় হইয়া উঠিয়াছিল মরণ, মানুষ কি সে লোভ ছড়িতে পারে? নিজে দাঁড়াইয়া সব সে দেখিয়াছিল। আগাগোড়া, মরণ এবং কারণ চিরদিনের জন্য তারই মনে গাঁথা হইয়া রহিল। তাকে জড়াইয়া গেলেন কেন ? সে ম্লেচ্ছ নাস্তিক, শেষ পর্যন্ত সে অবিশ্বাস করিয়া আসিয়াছে যাদবের অলৌকিক শক্তিতে, তবু হাসপাতাল করার ব্যাপারে তারই হাতে সমস্ত কর্তৃত্ব ছাড়িয়া দিয়া গেলেন। তাকে বিশ্বাসী করার জন্য কী ব্যাকুলতা ছিল যাদবের, শশীর সে কথা মনে পড়ে। মানুষটাব চরিত্রের কত আশ্চর্য দিক যে একে একে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে থাকে। এই উইলের বিষয় তাকে কিছু না জানানো, এও এক অসাধারণত্ব যাদবের। জানাইয়া গেলে ভার গ্রহণ করিতে সে অস্বীকার করিতে পারিত না, তবু যে যাদব জানান নাই তার কারণ হয়তো আর কিছুই নয়,-এতগুলি টাকা তার অধিকারে রাখিয়া যাওয়ার জন্য যদি তার সহজ ব্যবহারের ব্যতিক্রম হয় ? কৃতজ্ঞতায় হােক আর যে কারণেই হোক, মন-রাখা কথা যদি শশী বলে ? শেষ কয়েকটা দিনে তঁরা যোগসাধনার ক্ষমতায় শশীর বিশ্বাস জন্মিলে যদি বুঝিতে না পারা যায় এ বিশ্বাস স্বতোৎসারিত, এর পিছনে আর কোনো পার্থিব বিবেচনার প্রেরণা নাই ? বিকালে গোবর্ধন আসিল। গ্রামে ফিরিতে হইয়া গেল। রাত। শশীর কাছে সমস্ত কথা শুনিয়া বিস্ময়াবিষ্ট গোপাল বলিল, এত টাকা লোকটা পেল কোথায় রে, অ্যা?