পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা 88 দেখিত না, সেগুলি যদি সফল হয় এবার। কিন্তু নিজেকে এখানেও সে মিশ খাওয়াইতে পারে না। আজন্মের অভ্যাস ও প্রকৃতি এখানেও ঘা খাইয়া আহত হয়। গায়ের চেনা রূপ, চেনা মানুষগুলির কথা মনে পডিমা মাতিব চোখ ছলছল করে। কতদিন ওদের সে দেখিতে পায় নাই। সন্ধ্যার সময় পরান হয়তো মোক্ষদা ও কুসুমের সঙ্গে তার কথা বলাবলি কবে। শশীও হয়তো কোনোদিন আসিয়া বসে। কবে কুমুদ তাহকে গাওদিয়ায় লইযা যাইবে কে জানে! মতি বলে, এখেনে তো আমবা থির হয়ে বসলাম, এবাব দাদাকে একটি পত্র দাও ? ক’ত ভাবছে ওবা । কুমুদ বলে, এর মধ্যে ভুলে গিয়েছ মতি ? কী? কী ভুলে গিয়াছি ? আমায় বলনি গাওদিয়ার কথা ভুলে যাবে, কোনো সম্পর্ক থাকবে না। গাওদিয়ার সঙ্গে ? ভালো করে তোমায় আমি বুঝিযে দিইনি বিয়ের আগে, আমাব সঙ্গে আসতে হলে জন্মের মতো আসতে হবে ? চিঠি লেখালেখি চলবে না, তাও বলেছিলাম মতি। সেই কথা। তালবনের সেই অবুঝ বিহ্বল ক্ষণের প্রতিজ্ঞা! কুমুদ সে কথা মনে রাখিয়াছে? মতির বড়ো ভয় হয। কুমুদ যা বলিয়াছিল। তাই সে স্বীকাব কবিয়ছিল বটে, কিন্তু সে তো তখন বুঝিতে পারে নাই বাজপুত্র প্রবীরের সঙ্গে থাকিলেও গাওদিয়ার জন্য কোনোদিন তাহাব মন কেমন করিবে । নতুন জীবন, নতুন জগৎ, পুতুলের মতো কুমুদের হাতে নড়া-চডা---এ কল্পনাতেই তার যে ভাবিবার বুঝিবার শক্তি থাকিত না। কুমুদ কী সে কথা আজ অক্ষবে অক্ষবে পালন করিবে নাকি ? মতি ক্ষীণস্বাবে বলে, সে তো সত্যি নয় ? তাই বুঝি ভেবেছিলে তুমি, তামাশা করছি ? দিন কাটিযা যায। জীবনে আর কোনোদিন গাওদিয়ায় যাইতে পাইবে না ভাবিয়া মতির যখন কষ্ট হয় না, কঁচা মনে তখন কম-বেশি আশা আনন্দোব সঞ্চাব হয়। শৃঙ্খলার যথেষ্ট অভাব থাকিলেও জীবন এখানে মোটামুটি নিয়মানুবতী। আর মাঝে মাঝে কুমুদকে যতই ভযানক, নির্মম ও পর মনে হােক, কী একটা আশ্চর্য মন্ত্রে কুমুদ তাহাকে মুগ্ধ করিয়া রাখে। একটু নির্ভর শিখিয়াছে মতি। সে জানে আবোলতাবোল খরচ করিযা যত নিঃস্বই কুমুদ হোক, টাকার জন্য কখনও তাব আটকায় না। তা ছাড়া, চাবিদিকে ধার করিয়া রাখিয়া কপর্দক-শূন্য অবস্থাতেই কুমুদ যেন সুস্থ থাকে। টাকা তাকে কামড়ায় ; ঘরে টাকা থাকিলে রাত্ৰে যেন তার ঘুম আসে না। তা ছাড়া, আবও একটা ব্যাপার মতি ক্ৰমে ক্ৰমে টের পাইযাছে। তাহাকে ভাঙিয়া গডিবার কল্পনাটা কুমুদ শুধু মুখেই বলিতে ভালোবাসে, কাজ কিছু করিবার তার উৎসাহ নাই। জীবনে আর কিছুই কুমুদ চায় না, যখন যা খেয়াল জাগে সেটা পরিতৃপ্ত করিতে পারিলেই সে খুশি। নিয়ম, দায়িত্ব, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত এগুলি তার কাছে বিষের মতো। কথা-সর্বস্বও বটে কুমুদ। সে যখন বড়ো বড়ো কথা বলে, সায় দিয়া যাওয়াই যে যথেষ্ট, এটুকু জানিয়াও একদিকে মতি খুব নিশ্চিন্ত হইয়াছে। তবে কুমুদের সেবা করিয়া করি যা মতি বড়ো শ্রান্তি বোধ করে, জ্বালাতন হয়। এক এক সময় তাহার মনে হয় যে কুমুদের বুঝি সে বউ নয়, দাসীসিগারেট ধরানো হইতে পা টিপিয়া দেওয়া পর্যন্ত অসংখ্য সেবা করিবে বলিয়া অত ভালোবাসিয়া কুমুদ তাহাকে বিবাহ করিয়াছে। একটু খেলা চায় মতি, নিজের একটু আরাম বিলাস। কুমুদের জ্বালায় তা জুটিবার নয়। আগ্রহের সঙ্গে মতি জয়া ও বনবিহারীর জীবনযাত্রা লক্ষ করে। জীবনকে ওরা এই ক্ষুদ্র গৃহাংশে আবদ্ধ করিােয়ছে; বাহির হইতে কোনােরকম বৈচিত্ৰ্য আহরণের চেষ্টা নাই। সারাদিন ছবি আকে বনবিহারী, শুধু ছবি বেচিবার জন্য বাহিরে যায়, বাকি সময় ঘরে বন্দী করিয়া রাখে নিজেকে।