পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা 88Գ মতিকে বলিতে গিয়া তাহার বুঝিবার শক্তির অভাবে জয়া আহত হইয়াছে। বিপুল সম্ভাবনাপূর্ণ কত বড়ো একটা জীবন যে ঘরের পাশে পঙ্গু হইয়া আছে, মতির তাহা ধারণা করিবার ক্ষমতা পর্যন্ত নাই জানিয়া মেয়েটার প্রতি একটু বিরূপ হইয়াছে বইকী জয়ার মন! হাসিয়া উড়াইয়া দিলেও কুমুদ ও তার সম্বন্ধে মতির ঈর্ষা ও সন্দেহটা কিছু কিছু জয়া যে টেব পায় নাই এমন নয় । বেপরোয়া কুমুদ যে জয়াকে কিছু কিছু ভয় করে মতি আজকাল তাহা বুঝিতে পারিয়াছে। এখানে সে যে অনেকটা সংযত হইয়া আছে তা জয়ার জন্যই। এমন বঁকাভাবে মতি জয়াকে এই কথাটা শোনায় যে জয়া মনে মনে রাগ করে। কী যে তুই বলিস ! কেন, আমাকে ভয় করে চলবে কেন ? তোমাকে যেন সমীহ করে চলে দিদি ! কী করে তুই তা জানিলি ? মতি সগৰ্বে বলে, আমি ও সব জানতে পারি দিদি, যত বোকা ভাব অত বোকা আমি নই। জয় বিরক্তভাবে বলে, তাই দেখছি। হোটেলে বনবিহারী অল্প সময়ের জন্য যাইত, তখন তাকে মতির যে রকম মনে হইয়াছিল। এখানে দেখিল সে একেবারেই অন্যরকম। ভয়ানক ব্যস্ত মানুষ, সময়ের সব সমযেই অভাব। ছবি আকিতে আঁকিতে ভ্ৰতিও কি আসে না লোকটার! তুলিটি হাতে ধরাই আছে। প্রথমে মতির মনে হইয়াছিল। সে বুঝি হাসি তামাশা খুব ভালোবাসে, হােটেলের ঘরে কী ভাবেই সে হাসাঁইত মতিকে! এখানে বনবিহারীকে তার মনে মনে হয় একটু ভেঁাতা, একটু নিস্তেজ। তার কাছে স্বামীকে জয়া একদিন যে রকম প্রতিভাবনা তেজস্বী মানুষ বলিয়া প্ৰতিপন্ন করিতে চাহিয়াছিল, বনবিহারী সে রকম একেবারেই নয়। বরং তাকে ভীবুই বলা যায়। জয়াকে সে যে অন্তত খুব ভযা করে, কুমুদের চেয়ে বেশি, তাতে সন্দেহ নাই। এমন নিরীহ সাধারণ লোকটির সম্বন্ধে জয়ার ও রকম ধারণা কেন মতি বুঝিতে পারে না! খুব বড়ো কিছু করিতে পারিত বনবিহারী, দেশ-বিদেশে নাম ছড়াইত, কেবল দারিদ্র্যের জন্য পারিয়া উঠিল না,---মতির মনে হয়। এই আপশোশ জয়া তৈরি করিয়াছে নিজে । ছবি আঁকিয়া মানুষ নাকি আবার বড়ো হয় ! প্রতিভা, আর্ট শিল্পীর প্রতিষ্ঠালাভ এ সব যে কী পদার্থ, মতির তা জানা নাই, তবু জয়া ও বনবিহারীর সম্পর্কেব খাপছাড়া দিকটা সে বেশ উপলব্ধি করিতে পারে। তেজ যা আছে জয়ারই আছে, স্বামীকে সে মনে করে হইতে-পারিত লাট সাহেব! নিজের ক্ষমতাব পরিচয় বাখিয়াও জয়াবা ভয়ে বনবিহারী এতে সায় দিয়া চলে, নিপীড়িত বঞ্চিত সাজিয়া থাকে জয়ার কাছে। গরিব গৃহস্থকে স্ত্রীব কাছে রাজ্যচু্যত রাজার অভিনয় করিতে হইলে যেমন হয় বনবিহারীরও তেমনি বিপদ হইয়াছে। জয়া বলিয়াছিল, আমার যদি টাকা থাকত মতি! টাকার জন্য ওঁকে যদি ছবি আঁকতে না হত ! টাকার জন্যেই তো সবাই সব কাজ করে দিদি, করে না ? বাজে লোকে করে। যারা কবি আর্টিস্ট তাদের কি ও সব তুচ্ছ দিকে নজর দিলে চলে? মতি একটু ভাবিয়া বলিয়াছিল, টাকা জমীও না কেন ? হাতে টাকা এলেই যা করে সব খরচ কর, তোমার স্বভাবও ওর মতো দিদি। জয়া বলিয়াছিল, তুই ও সব বুঝবি না মতি। শিল্পীর মন কত কী চায়, কিছুই জোগাতে পারি না! টাকা থাকলে তবু দুদিন স্বচ্ছলভাবে চালাই, কোনো খোরাক তো পায় না প্রতিভার। মতি গিয়া কখনও পিছনে দাঁড়াইয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে বনবিহারীর ছবি আঁকা দ্যাখে। বনবিহারীর ছবিতে গাছ-পালা, বাড়ি-ঘর, মানুষ, মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ সবই তার কেমন অদ্ভুত মনে হয়।