পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8や2 মানিক রচনাসমগ্র অতগুলি পাখি আকাশে বারবার দিক পরিবর্তন করে একসঙ্গে, সকাল ও বিকাল হইলে উড়িবার সময় একসঙ্গে সবগুলি পায়রার পাখার নীচে রোদ লাগিয়া ঝকঝকি করিয়া ওঠে, শ্যামা অবাক হইয়া ভাবে, কখন কোনদিকে বাঁকিতে হইবে সবগুলি পাখি একসঙ্গে টের পায় কী করিয়া ? ধানকলের এক কোনায় ছোটাে একটি পুকুর, ইঞ্জিন ঘরের ওদিকে আরও একটা বড়ো পুকুর আছে, বয়লারের ছাই ফেলিয়া ছোটাে পুকুরটির একটি তীরকে ওরা ধীরে ধীরে পুকুরের মধ্যে ঠেলিয়া আনিয়াছে, পুকুরটা বুজাইয়া ফেলিবে বােধ হয়। ছাই ফেলিবার সময় বাতাসে রাশি রাশি ছাই সাদা মেঘের মতো টিনের প্রাচীর ডিঙাইয়া, বেলের বাধা পার হইয়া কোথায় চলিয়া যায়। আজকাল এ সব শ্যামা যেমন ভাবে চাহিয়া দ্যাখে কতকাল তেমনই ভাবে সে তা দ্যাখে নাই। বিকালে ছাদে গিয়া সে মণিকে ছাড়িয়া দেয়, মণি বকুলের সঙ্গে ছান্দময় ছুটািছুটি করে। আলিসায় ভর দিয়া শ্যামা কাছে ও দূরে যেখানে যা কিছু দেখিবার আছে দেখিতে থাকে, বোধ করে কেমন একটা উদাস উদাস ভাব, একটা অজানা ঔৎসুক। পরপর অনেকগুলি গাড়ি রেললাইন দিয়া দুদিকে ছুটিয়া যায়, তিনটা সিগন্যালের পাখা বারবার ওঠে নামে। ধানকলের অঙ্গনে কুলিমেয়েরা ছড়ানো ধান জড়ো করিয়া নৈবেদের মতো অনেকগুলি স্তুপ করে, তারপর হােগলার টুপি দিয়া ঢাকিয়া দেয়। ছোটাে পুকুরটিতে ধানকলেব বাবু জাল ফেলান, মাছ বেশি পড়ে না, এতটুকু পুকুবে মাছ কোথায়?--জাল ফেলাই সার। শ্যামাব হাসি পায। তাহার মামাবাড়ির পুকুরে ও জাল ফেলিলে আর দেখিতে হইত না, মাছের লেজের ঝাপটায় জাল খানখান হইয়া যাইত। পাবিপার্শ্বিক জগতের দৃশ্য ও ঘটনা শ্যামা এমনই ভাবে খুটিয়া খুটিযা উপভোগ করে, বাড়িঘর, ধানকল, রেললাইন, রাস্তার মানুষ, এ সব আর কবে তাহার এত ভালো লাগিয়াছিল ?-- অথচ মনে মনে অকাবণ উদবেগ, দেহে যেন একটা শিথিল ভারবোধ,-হাইতোলা আলস্য। বিধান আজকাল বিকালের দিকে শঙ্করদের বাড়ি খেলিতে যায়, ছেলেকে না দেখিয়া তার কী ভাবনা হইয়াছে ? শীতল বলে, বুড়ো বয়সে তোমার যে চেহারার খোলতাই হচ্ছে গো, বয়েস কমছে, নাকি দিনকে দিন ? শ্যামা বলে, দূর দূর। কী সব বলে ছেলের সামনে! শীতলের নজর পড়িয়াছে, শ্যামার ছেড়া কাপড় দেখিয়া তাহার চোখ টাটায়, শ্যামার জন্য সে রঙিন কাপড় কিনি যা আনে। শ্যামা প্রথমে জিজ্ঞাসা করে, কি টাকা নিলে? টাকা পেলে কোথা ৮ হ্র, কটা টাকা আর পাইনে আমি,-উপরি পেয়েছি। কাল। একটি পয়সা তো দেও না, আমার খরচ চলে কীসে উপবি না পেলে ? খরচ চলে? শীতল তাহা হইলে আরও উপরি টাকা পায়, খুশি মতো খরচ করে, তাহাকে যে টাকা আনিয়া দেয তাই সব নয় ? শ্যামা বাগিয়া বলে, কী রকম উপরি পাও শুনি ? দশ বিশ টাকা, আর কত ? নিশ্চয় আরও বেশি, মিথ্যে বলছি বাবু তুমি,--নিজে নিজে খরচ করা তো সব ? আমার এদিকে খরচ চলে না, ছেড়া কাপড় পরে আমি দিন কটাই। আরে মুশকিল, তাই তো কাপড় কিনে আনলাম।---আচ্ছা তো নেমকহারাম তুমি। শ্যামা বঙিন কাপড়খানা নাড়াচাড়া করে, মিষ্টি করিয়া বলে, কী টানাটানি চলেছে বোঝা না তো কিছু, কী কষ্টে যে মাস চালাই, ভাবনায় রাতে ঘুম হয় না,-দু-চারটে টাকা। যদি পাও কেন নষ্ট কর ?-- এনে দিলে সুসাের হয। তোমার খরচ কী ? বাজে খরচ করে নষ্ট কর বই তো নয়, যা স্বভাব তোমার জানি তো! হাতে টাকা এলে আঙুলের ফাক দিয়ে গলে যায়। এবার থেকে আমায় এনে দিও, তোমার যা দরকার হবে চেয়ে নিয়ে,--আর কিটা মাস মোটে, ধারণটা শোধ হয়ে গেলে তখন কি আর টানাটানি থাকবে, না তুমি দশ-বিশ টাকা বাজে খরচ করলে এসে যাবে?