পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in পুতুলনাচের ইতিকথা 8Գ Տ শশী বলিল, এতবেলায় বাড়ি ফিরলাম, খাব না দাবি না ছুটে সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে যাব ? কী যে বলেন তার ঠিক নেই। গোপালের উৎসাহ নিভিয়া গেল। বলিল, আমি কথা কইলেই তুই চটে উঠিস শশী। শশী বলিল, চটব কেন, সকাল থেকে খাইনি কিছু, খিদে তেষ্টা তো আছে মানুষের ? খাসনি ? সকাল থেকে খাসনি কিছু?--গোপাল ব্যস্ত হইয়া উঠিল, শিগগির স্নান করে নে। তবে। ও কুন্দ, তোরা সব গেলি কোথায় শুনি ? সকাল থেকে কিছু খায়নি। শশী,-—সব কটাকে দূর করব এবার বাড়ি থেকে। বিকালে শশী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা কবিয়া আসিল। সাতগাঁর স্কুল, গাওদিয়ার হাসপাতাল সব শীতলবাবু তাহাকে দেখাইয়াছেন, শশীকে বসাইয়া অনেকক্ষণ হাসপাতালের সম্বন্ধে কথা বলিলেন। যাদবেব মরণের ইতিহাসটা মন দিয়া শুনিলেন। এ বিষয়ে অদম্য কৌতুহল দেখা গেল তার। শশী নিজে দাঁড়াইয়া সব দেখিয়াছে? ব্যাপারটা নিজে তবে সে একটু ব্যাখ্যা করুক না ? শশীর আজ কিছু ভালো লাগিতে ছিল না, তাছাড়া যাদবের ও পাগলদিদির মরণকে তার ব্যাখ্যা করিবার উপায় নাই। চিরদিন শুধু তার মনে মনেই থাকিবে। তারপর এক কাপ চা খাওয়াইয়া হাসপাতালের ফান্ডে একশত টাকা চাঁদা দিবার প্রতিশ্রুতি দিয়া ম্যাজিস্ট্রেট শশীকে বিদায় দিলেন। সেখান হইতে সে শীতলবায়ুক্ত বাড়ি গেল। কিছু না বলিয়া উধাও হওয়ার জন্য শশীকে একচেটি বকিলেন শীতলবাবু, তবপর তিনিও এক কাপ চা খাওয়াইয়া শশীকে বিদায় দিলেন। তখন সন্ধা পার হইয়া গিয়াছে। শীতলবাবু সঙ্গে আলো দিতে চাহিয়াছিলেন, পকেটে টর্চ আছে বলিয়া শশী বারণ করিয়া আসিয়াছে। সমস্ত পথ একবারও সে টৰ্চেব আলো ফেলিল না, অন্ধকারে হাঁটিতে লাগিল। হাসপাতালে নিজেব ঘরে গিযা সে বসিল। হাসপাতালের কুড়ি টাকা বেতনের কম্পাউন্ডাব বোধ হয় আজ এ সময় শশীর আবির্ভাব প্রত্যাশা করে নাই, কোথায় যেন চলিয়া গিয়াছে। প্রায় দুঘণ্টা পরে সে ফিরিয়া আসিল। শশী। কিন্তু তাহাকে কিছুই বলিল না। হাসপাতালে ছটি বেড, তার মধ্যে দুটি মাত্র দুজন রোগী ফিবিল। কী আজ বিগডইয়া গিয়াছে মন! বাসুদেব বঁড়িয্যের বাড়িটা অন্ধকার, সামনে সেই প্ৰকাণ্ড জাম গাছটা, যার ডাল ভাঙিয়া পড়িয়া একটা ছেলে মরিয়াছিল। মরণের সঙ্গে কত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শশীব, তবু সেই ছেলেটাকে আজও সে ভুলিতে পারিল না। চিকিৎসার ভুল হইয়াছিল কি ? দেহের ভিতরে কি এমন কোনো আঘাত লাগিয়াছিল ছেলেটার, সে যাহা ধরিতে পারে নাই ? আজ আর সে কথা ভাবিয়া লাভ নাই। তবু শশী ভাবে । গ্রামের এমন কত কী শশীর মনে গাঁথা হইয়া আছে। এ জন্য ভাবনাও হয় শশীব। গ্রাম ছাড়িয়া সে যখন বহু দূর দেশ চলিয়া যাইবে, গ্ৰাম্য জীবনের এসব অসংখ্য ছাপ যদি মন হইতে তার মুছিয়া না যায় ? চিন্তা যদি তার শুধু এই সব খণ্ড খণ্ড ছবি দেখা আর এই সব ঘটনার বিচার করায় পর্যবসিত হয় ? শ্ৰীনাথের দোকানে একটু দাঁড়ায় শশী । কী খবর শ্ৰীনাথ ? মেয়ের জ্বর ? কাল একবার নিয়ে যেও হাসপাতালে, ওষুধ দেব। চলিতে চলিতে শশী ভাবে যে তার কাছে অসুখের কথাই বলে সকলে, ওষুধ চায়। বাঁধানো বকুলতলাটা ঝরা ফুলে ভরিযা আছে ; এত ফুল কেন? বাড়ির সামনে বাঁধানো দেবধর্মী গাছতলাটা সেনদিদি বুঝি আর সাফ করে না ? বাড়িতে ঢুকিবার আগে শশী দেখিতে পায় পরানের বড়ো ঘরের জানালােটা আলো হইয়া আছে। বাপ আসিয়াছে বলিয়া কুসুম বোধ হয় আজ তার বড়ো ঝুলানো আলোটাতে তেল ভরিয়া জ্বলিয়া দিয়াছে। মনটা কেমন করিয়া ওঠে। শশীর। হয়তো পরশু, হয়তো তার পরদিন কুসুম গাঁ চাড়িয়া যাইবে, আর আসিবে না।