পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8Գ Հ মানিক রচনাসমগ্ৰ QVS06GKi ঝোকের মাথায় কাজ করােব অভ্যাস শশীর কোনোদিন ছিল না। মনের হঠাৎ জাগা ইচ্ছাগুলিকে চিরদিন সে সামলাইয়া চলিবাব চেষ্টা করে। তবে এমন কতকগুলি অসাধারণ জোরালো হঠাৎ-জাগা ইচ্ছা! মানুষের মধ্যে মাঝে মাঝে জাগিয়া ওঠে যে সে সব দমন করার ক্ষমতা কারও হয় না। সকালে উঠিয়া কিছুই সে যেন ভাবিল না, কোনো কথা বিবেচনা করিয়া দেখিল না, সোজা পরানের বাড়ি গিয়া রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়াইয়া বলিল, একবার তালবনে আসবে বউ ? কুসুম অবাক। তালবনে ? কেন, তালবনে কেন এই সকালবেলা ? এসো। কটা কথা বলব তোমাকে । কথা বলবেন ? হাসৰ্প না কঁদব ভেবে পাই না যে ছােটােবাবু! জন্মবয়সে আজ প্রথম আমাকে যেচে কটা কথা বলতে এলেন, তাও তালবনে ডেকে! যান, আমি আসছি। তালবনের সেই ভূপতিত তালগাছটায় শশী বসিয়া রহিল, এমনই সকালবেলা একদিন তাকে ডাকিয়া আনিয়া কুসুম যেখানে বসিয়া মতির কথা শুনিয়াছিল। খানিক পরে আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা খেলাচ্ছলে মৃদু মৃদু শব্দে বাজাইতে বাজাইতে কুসুম আসিল। এত উৎফুল্ল কেন কুসুম আজ, কাল যে চিরতরে বিদায় গ্রহণ করিবে? মুখখানা একটু তাহার স্নান দেখাক, চোখে থাক গোপন বোদনেব চিহ্ন ? কথা শশী বলিতে পারিল না। নিজের মুখখানা স্নান করিয়া কুসুমের ভাব দেখিতে লাগিল। হাসব ?--- কুসুম জিজ্ঞাসা করিল। কেন, হাসবে কেন ? কুসুম হাসিয়া বলিল, আমার হাসি দেখলে আপনার মন নাকি জুড়িযে যায় ? তই শূদ্ধোচ্ছি। শশী বলিল, তামাশা করাব জন্যে তোমায় এখানে ডাকিনি বউ। আহা, তা তো জানি না! তামাশাই করলেন চিবকাল, তাই ডাকলে মনে হয় তামাশা করার জন্যেই বুঝি ডেকেছেন। বসি তবে । বসে শুনি কী জন্য ডাকলেন। শশী বলিল, এ কথা কী করে বললে বউ, চিরকাল তোমার সঙ্গে তামাশা করেছি ? তামাশা নয়? তবে ঠাট্টা বুঝি ? শশী একটু বাগ করিয়া বলিল, তোমার কী হয়েছে বুঝতে পারছি না বউ। কুসুম তবু হালকা সুর ভারী করে না। বলিল, কী করে বুঝবেন ? মেয়েমানয্যের কত কী হয়, সব বোঝা যায না । হলেনই বা ডাক্তার ! এ তো জ্বর জালা নয়। শশী জ্বালা বোধ করে। এ কি আশ্চর্য যে কুসুমকে সে বুঝিতে পারে না, মৃদু স্নেহসিঞ্চিত অবজ্ঞায় সাত বছর যার পাগলামিকে সে প্রশ্রয় দিয়াছিল। শশীর একটা দুর্বোধ্য কষ্ট হয়। যা ছিল শুধু জীবনসীমার বহিঃপ্রাচীর, হঠাৎ তার মধ্যে একটা চোরা দরজা আবিষ্কৃত হইয়াছে, ওপাশে কত বিস্তুতি, কত সম্ভাবনা, কত বিস্ময়। কেন চোখ ছলছল করিল না কুসুমের ? একবার বাপের বাড়ি যাওয়ার নামে আছাড খাইয়া তার কোমর ভাঙিয়াছিল, যদি বা শেষ পর্যন্ত গেল ফিরিয়া আসিল পনেরো দিনের মধ্যে। এখানে এমন ভাবে হয়তো এই তাদের শেষ দেখা, এ জীবনে হয়তো আর এত কাছাকাছি তারা আসিবে না, আর আজ একটু কঁাদিল না। কুসুম, গাঢ় সজল সুরে একটি আবেগের কথা বলিল না ? কুসুমের মুখে ব্যথার আবির্ভাব দেখিতে শশীর দুচোখ আকুল হইয়া ওঠে, অস্ফুট কান্না শুনিবার জন্য সে হইয়া থাকে উৎকর্ণ। কে জানিত কুসুমের দৈনন্দিন কথা বা ব্যবহারে মেশানো অসংখ্য সংকেত, অসংখ্য নিবেদন এত প্রিয় ছিল শশীদার, এত সে ভালোবাসিত কুসুমের জীবন-ধারায় মৃদু, এলোমেলো, অফুরন্ত কাতরতা ? চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবে আর আজ এই তালবনে তার এত কাছে বসিয়া খেলার ছলে কুসুম শুধু বাজাইবে চাবি! কী অন্যায় কুসুমের, কী সৃষ্টিছাড়া পাগলামি!