পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8: SCO মানিক রচনাসমগ্ৰ শশীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়াই কাজটা সে যেন হাসিল করিয়াছে এমনিভাবে গলা নামাইয়া গোপাল আবার বলিল, আসল কথা কী জানিস বাবা, এক ঢ়িলে দুটাে পাখি মেরেছি। কুন্দকেও সরালাম, পরের ছেলে ঘাড়ে করার দায় থেকেও রেহাই পেলাম। যা খুশি করুক গিয়ে এবার, আমি কিছু জানি না— কেঁদে কেটে চিঠি লেখে দু-চার টাকা পাঠিয়ে দেব, বাস, ফুরিয়ে গেল সম্পর্ক। তাই যদি ইচ্ছা ছিল গোপালের, বিপিনের কােছ হইতে সেনদিদির ছেলের ভার গ্রহণ করিবার তার কী প্রয়োজন ছিল শশী তা জানিতে চায় না। তাই রক্ষা, জবাব গোপাল দিতে পারিত না। শশীকে গোপাল ছাড়িতে পারে না, সেনদিদির ছেলেকে ফেলিতে পারে না, অনেক ভাবিয়া চারিদিক রক্ষণ করার জন্য পাকা রাজনীতিকের মতো সে যে চাল চালিয়াছে তার সমর্থনের জন্য এ রকম দুটাে একটা বানানো পাকা কথা না বলিলে চলিবে কোন! ছেলের সঙ্গে তর্ক করিয়া অখণ্ড যুক্তি দাঁড় করানোর জন্য তো এ সব বলা নয়, এ শুধু তাকে জানানো যে হার গোপাল মানিয়াছে, ওরে পাথরের পুত্রদেবতা, এবার তুই তোর ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ছাড়। সেনদিদির ছেলেকে সরাইয়া নেওয়ার জন্য শুধু নয়, তাকে ধরিয়া রাখার জন্য গোপালকে এমন উতলা হইয়া উঠিতে দেখিলে হয়তো শশী মত বদলাইয়া ফেলিত, আবার হয়তো বাতিল হইয়া যাইত তাহার গ্ৰামত্যাগের কল্পনা। এখন বড়ো দেরি হইয়া গিয়াছে, মন তো শশীর কখন চলিয়া গিয়াছে দুরন্তর দেশে নবতব জীবনযাপনে, এখন শুধু বেঁচেকা ঘাড়ে সেখানে পৌছানো বাকি-তাও দু-চারদিনেব মধ্যেই ঘটিবে। সারাদিন গোপালের নিশ্চিন্ত প্ৰফুল্লভাব শশীকে পীড়া দিল। সে বুঝিতে পারিল গোপাল ধরিযা লইয়াছে তাদের মধ্যে সমস্ত গোলমাল মিটিয়া গিয়াছে, দিনগুলি অতঃপর যেমন সহজভাবে কাটিতেছিল তেমনিভাবে কাটিতে থাকিবে। এমন একটা জটিল ব্যাপারের এত সহজে এ রকম মনোমত পরিণতি ঘটিবে গোপালকে ইহা বিশ্বাস কবিতে দেখিয়া আশ্চর্যও শশী কম হইল না। তাব কাছে কী প্ৰত্যাশা করে গোপালা? এমন আকুল আগ্রহে কেন সে তাকে ধরিয়া রাখিতে চায়? মতের তাদের কখনও মিল হইবে না, প্রতিদিন খুঁটিনাটি বাধিবে, স্নেহ মমতা শ্রদ্ধা ভক্তির পাহাড়কে চাপা দিয়া স্তুপাকাব হইয়া উঠিৰে অশান্তির হিমালয়! তবু শশীকে গ্রামে বসিয়া এই আত্ম-বিরোধময় সংকীর্ণ জীবনযাপন করিতে হইবে? এত বড়ো বিপুল পৃথিবী পড়িয়া থাকিতে তাদের দুটি বিরোধী ব্যক্তিত্বকে অর্থহীন অব্যবহার্য স্নেহের মোহে আশ্রয় করিয়া থাকিতে হইবে এই ক্ষুদ্র গৃহকোণ ? গৃহত্যাগের কারণ হিসাবে আজ তা বহুগুণে তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে। গ্রাম ছাড়িয়া যাইতে যে গভীর দুঃখ জাগিয়াছে শশীর মধ্যে, ও ধরনের মানসিক বিতৃষ্ণার অজুহাত তার কাছে খাটানো চলে না, আরও বড়ো লোভ, আরও বড়ো আকর্ষণ থাকা দরকার হয়। অথচ গোপালের পক্ষে তা ধারণা করাও অসম্ভব। শশী চলিয়া গেলে তার যাওয়ার ওই একটি কারণের কথাই গোপাল জানিয়া রাখিবে- সেনদিদির শীতলবাবু ডাকিয়াছিলেন। অমূল্যের সঙ্গে সন্ধ্যার পর শশী তার বাড়ি গিয়াছিল। অমূল্যকে জলটল খাওয়াইয়া শীতলবাবু সকাল সকাল ছাড়িয়া দিলেন, শশীকে ছাড়িলেন রাত্রির আহারের পর, অনেক রাত্রে। শীতলবাবু আরেক বিপদ হইয়াছেন। শশীর, দুবেলা ডাকেন। আর গেলেই কথায় কথায় পাগল করিয়া তোলেন শশীকে। বাড়ি ফিরিয়া শশী দেখিল আহারের স্থানে পাশাপাশি দুখানা আসন পাতা আছে এবং যে গোপাল আটটায় খাইতে বসে সে আজ তার প্রতীক্ষায় এগারোটা পর্যন্ত না খাইয়া বসিয়া আছে। এত দেরি করলে যে শশী? চট কবে মুখহাত ধুয়ে এসো, বসে পড়ি আমরা। শশী বলিল, আপনি বসুন, আমি খেয়ে এসেছি। শীতলবাবু না খাইয়ে ছাড়লেন না।