পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in G. O. মানিক রচনাসমগ্র শ্যামা বলিল, কদিন কেন? বরাবর থাকবেন,-আমরা থাকতে বুড়ো বয়সে হােটেলের ভাত খেয়ে মরবেন কী জন্যে ? আমিও তাই বলছিলাম।-পয়সাকড়ি কিছু করেছেন মনে হয়, আঁ্যা ? মনে তো হয়, এখন আমাদের অদেষ্ট । মামা একটা ঘুম দিয়া উঠিলে বিকালে তাহারা চারিদিকে ঘেরিয়া বসিয়া গল্প শুনিতে লাগিল, শহর-গ্রাম-অরণ্য-পর্বতের গল্প, রাজামহারাজা সাধুসন্ন্যাসী চােরাডাকাতের গল্প, রোমাঞ্চকর বিপদআপদের গল্প। মামা কি কম দেশ ঘুরিয়াছে, কম মানুষের সঙ্গে মিশিয়াছে! সুদূর একটা তীর্থের নাম করা, যার নামটি মাত্র শ্যামা ও শীতল শুনিয়াছে, যেমন রামেশ্বর সেতুবন্ধ, নাসিক, বদরিনাথমামা সঙ্গে সঙ্গে পথের বর্ণনা দেয়, তীর্থের বর্ণনা দেয়, সব যেন বুপ ধরিয়া চোখের সামনে ফুটিয়া ওঠে। সেই বিধবা সঙ্গিনীটি কতকাল মামার সঙ্গে ছিল কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারে না, মামার যাযাবর জীবনের ইতিবৃত্ত শুনিয়া কিন্তু মনে হয় চিরকাল সে দেশে দেশে ঘুরিয়াছে একা, সাথি। যদি কখনও পাওযা গিয়া থাকে সে পথের সাথি, পুরুষ। শ্যামা একবার সুকৌশলে জিজ্ঞাসা করে গ্রাম হইতে বাহিব হইয়া প্রথমে মামা কোথায় গিযাছিল, মামা সোজাসুজি জবাব দেয়, কাশী,---কাশীতে ছিলাম পাঁচ ছটা মাস, ভুলেটুলে গিয়েছি সে সব বাপু, সে কী আজকের কথা! শ্যামা বলে, একা একা ঘুরে বেড়াতে ভালো লগত মামা ? মামা বলে, একা ঘুবেই তো সুখ রে, ভাবনা নেই চিন্তা নেই যখন যেখানে খুশি পড়ে থাক, যেখানে খুশি চলে যাও, কারও তোয়াক্কা নেই, জুটল খেলে, না জুটল। উপোস করলে--চিরকাল ঘলেব কোণে কাটালি, সে আনন্দ তোবা কী বুঝবি ? একবার কী হল,-নীলগিরি, পাহাড়ের গোড়ায় একটা গ্রামে গিয়েছি। এক সাধুর সঙ্গে, গ্রামটার নাম বুঝি তুড়িগোড়িয়া, পাহাড়ের সারা চলে গিযেছে গ্রামের ধার দিয়ে। পাহাডে উঠে দেখতে ইচ্ছা হল। গা থেকে উডিয়া মেয়েরা পাহাড়ের বনে কাঠ কাটতে যায়, তাদের সঙ্গে গেলাম। সে কী জঙ্গল রে শ্যামা, এইটুকু সরু পথ দুপাশে এক পা সরবার জো নেই, যেন গাছপালার দেয়াল গাথা। ফিরবার সময় পথে হাতির পাল পড়ল, আর নামবার জো নেই। চারদিন হাতির পাল পথ আটকে রইল, চারদিন আমরা নামতে পারলাম না। কী সাহস সেই মেয়োগুলোর বলিহারি যাই, চারদিন টু শব্দটি করলে না, রাত্রে আমাকে বলত ঘুমোতে আর নিজেরা কাঠকটা দা বাগিয়ে ধরে পাহারা দিয়ে জেগে থাকত। আর একদিন-- সেদিন আর মামার জিনিসপত্র আনা হইল না, পরদিন গিয়া লইয়া আসিল । শ্যামা ভাবিয়াছিল মামা কত জিনিস না জানি আনিবে, হয়তো আঁটিবেই না ঘরে! মামা কিন্তু আনিল ক্যাম্বিসের একটা ব্যাগ আর কম্বলে জড়ানো একটা বিছানা,--লেপিতোশক নয়, দুটাে র্যাগ, খান তিনেক সুতির চাদর আর এই এতটুকু একটা বালিশ। শ্যামা অবাক হইয়া বলিল, এই নাকি তোমার সব জিনিস মামা ? মামা একগাল হাসিল, ভবঘুরের কী আর রাশ রাশ জিনিস থাকে। মা ? ব্যাগটা হাতে করি, বিছানা বগলে নিই, চলো এবার কোথায় যাবে দিল্লি না বোম্বাই।-ব্যাগটা হাতে তুলিয়া বিছানা বগলে করিয়া মামা যাওয়ার অভিনয় করিয়া দেখাইল । তাই হইবে বোধ হয়। আজ এখানে কাল সেখানে করিয়া যে বেড়ায় বাকসো-প্যাটরার হাঙ্গামা থাকিলে তাহার চলিবে কেন ? কিন্তু এমন ভবঘুরেই যদি মামা হইয়া থাকে। তবে তো টাকাকড়ি কিছুই সে করিতে পারে নাই ? শ্যামা ভাবিতে ভাবিতে কাজ করে। প্ৰথমে সে যে ভাবিয়াছিল বিদেশে মামা অর্থে পার্জন করিয়াছে, বেড়াইয়া বেড়াইয়াছে শুধু ছুটিছাঁটা সুযোগসুবিধা মতো, হয়তো তা সত্য নয়। মামার হয়তো কিছুই নাই। দেশেদেশে সম্পদ কুড়াই যা বেড়ানোর বদলে হয়তো শুধু বাউল সন্ন্যাসীর