পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in Vo N. মানিক রচনাসমগ্র বেশি কিছু নয়, পাঁচশটা টাকা। বাড়ি গিয়া শ্যামা ভাবিয়াছে, এ টাকা সে লইল কেমন করিয়া ? কেন লইল ? এখনই এমন কী অভাব তাহার হইয়াছে? ভবিষ্যতে আর কি তাহার সাহায্য দরকার হইবে না যে এখনি মাত্র পঁচিশটা টাকা লইয়া বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিরক্ত করিয়া রাখিল? তারপর শ্যামার মনে পডিয়াছে টাকাটা সে নিজে চাহে নাই, বিষ্ণুপ্রিয়া যাচিয়া দিয়াছে। নেওয়াটা। তবে বোধ হয় দোযের হয় নাই বেশি। বনগাঁযে মন্দাকে শ্যামা একদিন একখানা চিঠি লিখিল, সেই যে রাখাল সাতশো টাকা লইয়াছিল তার জন্য তাগিদ দিয়া। সে যে কত বড়ো বিপদে পড়িয়াছে এক পাতায় তা লিখিয়া, আরেকটা পাতা সে ভরিয়া দিল টাকা পাঠাইবার অনুরোধে। সব না পারুক, কিছু টাকা অন্তত রাখাল যেন ফেরত দেয়।—আমি কী যন্ত্রণায আছি বুঝতে পােরছ তো ঠাকুরবি ভাই? আমার যখন ছিল তোমাদের দিইছি, এখন তোমরা আমায় না দিলে হাত পাতিব কার কাছে? দিন সাতেক পরে মন্দার চিঠি আসিল, অশ্রুসজল। এত কথা সে চিঠিতে ছিল যে চাপ দিলে বুঝি ফোটাফোটা ঝরিয়া পড়িত। দাদা কোথায় গেল, কেন গেল, শ্যামা কেন আগে লেখে নাই, কাগজে-কাগজে বিজ্ঞাপন কেন দেয় নাই, দেশে দেশে খোজ কবিতে কেন লোক ছুটািয নাই, এমন করিয়া চলিয়া যাওয়ার সময় ছোটাে বোনটির কথা দাদার কি একবারও মনে পডিল না ? যাই হোক, সামনের রবিবার রাখল কলিকাতা আসিতেছে, দাদাকে খোজ কাবাব যা যা ব্যবস্থা দরকার সেই করিবে, শ্যামার কোনো চিন্তা নাই। টাকার কথা মন্দা কিছু লেখে নাই। রবিবার সকালে বাখালি ভারী ব্যস্ত সমস্ত অবস্থায় আসিয়া পড়িল, যেন শীতলেব পালানোর পর প্রায় একমাস কাটিয়া যায় নাই, যা কিছু ব্যবস্থা সে করিতে আসিয়াছে একঘণ্টােব মধ্যে সে সব না। কবিলেই নয়। বাডিতে পা দিয়াই বলিল, কী বৃত্তান্ত সব বলো তো বউঠান। শ্যামা বলিল, বসুন, জিরোন, সব বলছি। জিরোব ?--জিরোবার কী সময় আছে! মন্দার কাছে চিঠিতে শ্যামা শীতলের তহবিল-তছরূপের বিষয়ে কিছু লেখে নাই, রাখালকে বলি৩ে হইল। রাখাল বলিল, শীতলবাবু এমন কাজ করবেন, এ যে বিশ্বাস হতে চায় না বউঠান! বাগ ক1ে চলে-যাওয়া,-হ্য সেটা সম্ভব, মানুষটা রাগী, কিন্তু— অনেক কথাই হইল, কতক অর্থহীন কতক অবান্তর, কতক নিছক ব্যক্তিগত সমালোচনা ও মন্তব্য ; আসল কথাটা আবি ওঠেই না। শ্যামা রাখালের কথা তুলিবার অপেক্ষা করে, রাখিল ভাবে শ্যামাই কথাটা পাড়ােক ; সাবটা সকাল তাহাবা ঝোপের এদিক-ওদিক লাঠি পিটাইল, ঝোপ হইতে বাঘ বাহিব হইবে না পেখম-তোলা ময়ুর বাহির হইবে সকালবেলা সেটা আর ঠাহব করা গেল না। বাডিতে অতিথি আসিয়াছে, শ্যামা রধিতে গেল ; রাখাল গল্প জুড়িল মামার সঙ্গে। শ্যামা ভাবিল, কী আশ্চর্য পরিবর্তন আসে মানুষের জীবনে ? খোলা মাঠে কী ভাবে হিংস্ৰ শ্বাপদ-ভরা জঙ্গল গডিয়া ওঠে কয়েকটা বছবে ? মুখোমুখি বসিয়া আজ রাখালের মন ও তাহার মনের মুখ দেখাদেখি নাই। দুজনের খোলা মনে যে জঙ্গল গিজগিজ করিতেছে তারি মধ্যে দুজনে লুকোচুরি খেলিতেছে। না, ঠিক এ ভাবে শ্যামা ভাবে নাই, আমন কল্পনা তাহার কোথায়? সে সোজাসুজি সাধারণভাবেই ভাবিল যে রাখাল কী স্বার্থপব হইয়া উঠিয়াছে। জঙ্গলের বৃপকটা তাহার অনুভূতি। হঁ্যা, মানুষ বদলায়। বদলায় না বাড়িঘর, বদলায় না জগৎ । এমনই শীতকালে একদিন রাত্রে বারান্দায় শীতলের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় শীতে তাহাকে কঁাপিতে দেখিয়া রাখাল নিজের গায়ের আলোয়ান গায়ে জড়াইয়া দিয়াছিল, হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া বলিয়াছিল, বউঠান তুমি শোও, আমি দরজা খুলে দেব। শ্যামার সব মনে আছে, সে সব ভুলিবার কথা নয়। রাখাল তাকে যেন দামি পুতুল মনে করিত, এতটুকু আঘাত লাগিলে সে যেন ভাঙিয়া যাইবে এমনই যত্ন ছিল রাখালের, অসুখ হইলে কপালে হাত বুলানোর আর তো কেহ ছিল না। তাহার রাখাল ছাড়া!