পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in জননী W) টাকার কথাটা দুপুরে উঠিয়া পড়িল, রাখাল মাথা নিচু করিয়া বলিল, জানো তো বউঠান আমার রোজগার? পচানব্বুই টাকা মাইনে পাই, দুটাে সংসার, ছেলেমেয়ে, কোনো মাসে খরচ চলে কোনো মাসে ধারা হয। একটা বোনের বিয়ে দিয়েছি, এখনও একটা বাকি তারও বয়স হল, দু-এক বছরেব মধ্যে তার বিয়ে না দিলেও চলবে না, –এখন কী করে তোমার টাকা দিই বউঠান ?--তোমার অবস্থা বুঝি, আমার অবস্থা বুঝে দ্যাখো। সুতরাং তাহদের কলহ বাধিয়া গেল খানিক পরেই ; এমন শীতের দিনে জলে হাত ভিজাইয়া ঠান্ডা করিয়া হঠাৎ পরস্পরের গায়ে দিয়া একদিন যাহারা হাসাহসি করিত টাকার জন্য তাহাদের কলহ ? এ কী আশ্চর্য কথা যে সেদিনের স্মৃতি তাহারা ভুলিয়া গেল, সংসারের বৃঢ় বাস্তবতার মধ্যে যে ইতিহাস স্মরণ করা মাত্র দুদিন আগেও যাহারা অবাস্তব স্বপ্ন দেখিতে পারিত ধ্রু শ্যামা কড়া কড়া অপমানজনক কথা বলিল, সেই সাতশত টাকার উল্লেখ করিয়া রাখালকে সে একরকম জুয়াচোর প্রতিপন্ন করিয়া দিল। রাখাল জবাবে বলিল, শ্যামা যদি মনে করিয়া থাকে নিজের হকের ধন ছাড়া শীতলের কাছে কোনোদিন সে একটি পয়সা নিয়াছে, শীতল জেল হইতে ফিরিলে শ্যামা যেন অ্যাব একবাব তাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দ্যাখে। শ্যামা বলিল, হকের ধন কীসে ? রাখাল বলিল, শ্যামা তাব কী জানিবে ? মন্দার বিবাহ দিবার সময় শীতল যে জুয়াচুরি কবিয়াছিল, রাখাল বলিয়াই সেদিন তাহাব জাত বাঁচাই যাছিল, আর কেহ হইলে বিবাহসভা হইতে উঠিয়া যাইত। শীতল অর্ধেক গাযনা দেয নাই, পণের টাকা দেয় নাই একটি পয়সা। তারপর সেই গোড়ার দিকে প্রেসের কী সব কিনিবােব জন্য ভুলাই যা ভালাইয়া সে যে বাখালের পাঁচশত টাকা লইয়া এক পয়সা কোনোদিন ফেবত দেয নাই শ্যামা কি তা জানে ? সংসাবে কে কেমন লোক জানিতে রাখালের আব বাকি নাই । এই সব কথার আদান প্ৰদান কবিবার পর দুজনে বড়ো বিষন্ন হইয়া রহিল। রাখাল বিদায় হইল। বিকালে । শ্যামা বলিল, ঠাকুরজামাই! ভাবনায়-চিন্তায় মাথা আমার খারাপ হয়ে গেছে, রাগের সময় দুটাে মন্দ কথা বলেছি বলে আপনিও আমায় এই বিপদের মধ্যে ফেলে চললেন ? রাখাল বলিল, না না, সে কী কথা বউঠান, রাগ কেন করব ? তু" - ও দুটো কথা বলেছি, আমিও দুটো কথা বলেছি, ওইখানেই তা মিটে গেছে।--রাগারগির কী আছে? শ্যামা কঁাদিতে কঁাদিতে বুলিল, আপনারাই এখন আমার বল-ভরসা, আপনার না দেখলে কে আমায় দেখবো? ছেলেমেযে নিয়ে আমি ভেসে যাব ঠাকুরজামাই। বডোন্দিনের ছুটিতে আবার আসব বউঠান।--রাখাল বলিল। গতবার বড়েদিনের ছুটিতে সে আসিয়াছিল--এবারও আসিবে বলিয়া গেল। বাখাল ? সেই রাখালী? একদিন যে ছিল তাহার বন্ধুর চেয়েও বড়ো ? শীতের হ্রস্ব দিনগুলি শ্যামার কাছে দীর্ঘ হইয়া উঠিয়াছে দীর্ঘ রাত্রিগুলি হইয়াছে অন্তহীন। শীতলের বিছানা খালি, বকুলের বিছানা খালি। কী ভঙ্গি করিয়া মেয়েটা শুইত, ফুলের মতো দেখাইত না তাহাকে? গায়ে লেপ থাকিত না, শীতে মেয়েট কুণ্ডলী পাকাইয়া যাইত, শূইতে আসিয়া রোজ শ্যামা তাহার গায়ে লেপ তুলিয়া দিত। গভীর রাত্রে শূন্যদৃষ্টিতে শূন্যশয্যার দিকে চাহিয়া শ্যামা জাগিয়া থাকে, চোখ দিয়া জল পড়ে। আর তো মেয়ে নাই শ্যামার, ওই একটি মেয়ে ছিল। আর কী সে মেয়ে! শ্যামার এই ছোটাে বাড়িতে অতটুকু মেয়ের প্রাণ যেন আঁটিত না, ও যেন ছিল আলো, ঘরের চারিদিক উজ্জ্বল করিয়া ক্ৰ'নালা দিয়া বাহিরে ছড়াইয়া পড়িত। সে অত প্রচুর ছিল বলিয়া শ্যামা বুঝি তাকে তেমন আদর করিত না ? বকুল, ও বকুল, কোথায় গেলি তুই বকুল?