পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in V8 মানিক রচনাসমগ্র একদিন রাত্রে কে যেন পথের দিকের জানালায় টােকা দিতে লাগিল। শ্যামা জানালার খড়খডি ফাক করিয়া বলিল, কে ? মৃদুস্বরে উত্তর আসিল, আমি শামা আমি, দরজা খোলো। জানােলা খুলিযা শ্যামা দেখিল, শীতল একা নয়, সঙ্গে বকুল আছে। দরজা খুলিয়া ওদের সে ভিতরে আনিল, বকুলকে আনিল কোলে করিয়া। বকুলের গাযে একটা আলোয়ান জড়ানো, এই শীতে কি আলোয়ানে কিছু হয়, শ্যামার কোলে বকুল থারথার করিয়া কঁাপিতে লাগিল। শ্যামার মনে হইল। মেয়ে যেন তাহাব হালকা হইয়া গিয়াছে। ঘরে আসিয়া আলোতে বকুলের মুখ দেখিয়া শ্যামা শিহরিয়া উঠিল, ঠোঁট ফাটিয়া, গাল ফাটিয়া, মরা চামড়া উঠিয়া কী হইযা গিয়াছে বকুলের মুখ ? শ্যামা কথা কহিল না, লেপর্কাথা যা হাতের কাছে পাইল তাই দিয়া জড়াইয়া মেযেকে কোলে করিয়া বসিল, গায়ের গরমে একটু তো গরম পাইবে? বকুল তো এমন হইয়াছে, শীতল ? মাথায় মুখে সে কম্বন্ধটার জড়াইয়া আসিয়াছিল, সেটা খুলিয়া ফেলিতে শ্যামা দেখিল তার চেহাবা তেমনি আছে, পুলিশের তাড়ায় পথে-বিপথে ঘুবিয়া বেড়াইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। গাযে তাহার দামি নুতন গবাম কোট, চাদরটাও নুতন। না, শীতলেব কিছু হয নাই। মেয়েটাৰ অদৃষ্ট দুঃখ ছিল, সেই শুধু আধ-মরা হইযা আসিয়াছে। ওর জ্বর হযেছিল।—শীতল বলিল। জ্বর ? তাই বটে, অসুখ না হইলে মেয়ে কেন এত রোগ হইয়া যাইবে ? শ্যামা শীতলেৰ মুখের্ব দিকে চাহিল, চোখ দিয়া তাহাব জল গড়াইয়া পড়িল, ধরা গলায বলিল, জন্মে থেকে ওর একদিনেব। জানো গা গরম হয়নি। শীতল কি তাহা জানে না ? এ তাহাকে অনর্থক লজা দেওযা। শ্যামা এবার তাহাব প্ৰতিকারহীন অপকীর্তিব কথা তুলুক, তাহা হইলেই গৃহে প্রত্যাবর্তন তাহার সফল হয়। পরস্পবেব দিকে চাহিয়া তাহাবা যেন শত্ৰতাব পবিমাপ করিতে লাগিল! শ্যামাব কী কবিযাছে শীতল ? প্রেসেব টাকা। যদি সে চুবি কবিয়া থাকে, সে জন্য জেলে যাইবে সে। সে স্বাধীন মানুষ নয় ? শ্যামাব তো সে কোনো ক্ষতি করে নাই! ববং বাইশ বছব মাসে মাসে ওকে সে টাকা আনিয়া দিয়াছে। এবার যদি সে ছুটিই নেয়, কী বলিবার আছে শ্যামার ? এমনি সব কথা ভাবিতে গিয়া শীতলের বুঝি চোখ পডিল ঘুমন্ত ছেলে দুটির দিকে, মণি আব্ব ছোটাে খোকা, যার নাম ফণীন্দ্ৰ, বকুলেব গায়ে জড়ানোর জন্য ওদের গা হইতে লেপটাি শ্যামা ছিনাইয়া লইয়াছে। ওদের দেখিয়া শুধু নয়, কবে শীতল ভুলিতে পারিয়াছিল তার চেযে পরাধীন কেহ নাই, সৃষ্টিতত্ত্বের সে গোলাম, জেলে যাওয়াব, মরিয়া যাওয়ার অধিকার তাহার নাই ? সে পাগল বলিয়াই না। এ কথা ভুলিয়া গিয়াছিল? জানালা বন্ধ ঘরে শীতেব স্তব্ধ রাত্রি, এই ঘরে দায়ে-পড়া স্নেহমমতার সঙ্গে সুখশান্তির বিরাট সমন্বয়টা দিনে আসিলে বোঝা যাইত না। এই ঘবে এমনি শীতের বাত্রে লেপ মুড়ি দিয়া সে কতকাল ঘুমাইয়াছে! তুচ্ছ তুলার তেশকে, তুচ্ছ দৈনন্দিন ঘুম! তেমনিভাবে আব্ব সে কোনোদিন এখানে ঘুমাইতে পরিবে না। তুচ্ছ তুলাব তোশকে তুচ্ছ দৈনন্দিন ঘুম আজি কত দুর্লভ ! ধীরে ধীরে তাহাবা কথা বলিতে লাগিল, দুজনের মাঝে যেন দুস্তর ব্যবধান, একজন কথা বলিলে এতটা দূরত্ব অতিক্ৰম করিয়া আরেকজনের কাছে পৌঁছিতে যেন সময় লাগে। শ্যামা বলিল, টাকা কি সব খরচ করে ফেলেছি? শীতল বলিল, না, দুচার শো বোধ হয় গেছে মোটে। শ্যামা বলিল, তাহলে কালকেই তুমি যাও, কমলবাবুর হাতে পায়ে ধরে পড়ো গিয়ে, টাকা ফিরে পেলে তিনি বোধ হয়। আর গোলমাল করবেন না।