পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in Ե Հ মানিক রচনাসমগ্ৰ কলিকাতার চেয়ে ঢের বেশি সুখেই শ্যামা এখানে বাস করিতে লাগিল। পরের বাড়ি পরের আশ্রযে থাকিবাব একটু যা লজ্জা। এখানে আসিবার আগে শ্যামা ভাবিয়াছিল এমন নিরুপায় হইয়া আত্মায়ের বাড়ি যাইতেছে, পদে পদে কত অপমান সেখানে না জানি তাহার জুটিবে, এখানে কিছুদিন ভয়ে ভয়ে থাকিবার পর দেখিল গায়ে পড়িয়া অপমান কেহ করে না, সে যে এখানে আশ্রিতা, সময়ে-অসময়ে সেটা মনে করাইয়া দিবারও কেহ এখানে নাই, মানাইয়া চলিতে পারিলে এখানে বাস করা কঠিন নয়। এখানকার গ্ৰাম্য আবহাওয়াটিও শ্যামার বেশ লাগিল। শাহবতলির যে বাড়িতে বিবাহের পর হইতে এতকাল সে বাস করিয়াছিল। সেখানটা শহরের মতো ঘিঞ্জি নয়, তবু সেখানে তাহারা যেন বন্দীজীবন যাপন করিত, ইটের অরণ্যের মধ্যে প্রকৃতির যেটুকু প্রকাশ ছিল তা যেন শহরেব পার্কেব মতো ছেলে-ভুলানো ব্যাপার। তাছাড়া, সেখানে তাহারা ছিল কুনো, ঘরের কোণে নিজেদের লইয়া থাকিত, প্রতিবেশী থাকিয়াও ছিল না। এখানে জীবনের সঙ্গে জীবনেব। বডো নিবিড় মেশামেশি। মিতালি যেখানে নাই সেখানেও অজস্র মেলামেশা আছে, সহজ বাস্তব মেলামেশা, শহরেব মেলামেশার মতো কোমল ও কৃত্রিম নয়, খাটি জিনিস। শ্যামার ছেলেমেয়েরা যেন হাঁপ ছাড়িয়া বঁচিয়াছে। এখানে তাহারা প্ৰকাণ্ড অঙ্গন পাইয়াছে, বাগানপুকুর পাইয়াছে, ধুলামাটিতে খেলা করাব সুযোগ পাইযাছে, আব্ব পাইয়াছে সঙ্গী। বাডিতেই শ্যামাব প্রত্যেকটি ছেলেমেযেব সাথি আছে, বিধানেব জন্মেব সময় মন্দা যে কোলের ছেলেটিকে লইয়া কলিকাতায় গিযাছিল তাব নাম অজয়, সকলে অজু বলিয়া ডাকে, বিধানের সঙ্গে তাহাব খুব ভাব হইয়া গেল। অজয় এক ক্লাস নীচে পড়ে। পড়াশোনায় বিধান বড়ো ভালো, মন্দাবী ছেলেদের মাস্টার একদিন বিধানকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া এই রায় দিয়াছেন। মন্দা জানিযা খুশি হইয়াছে, বিধান কলিকাতার ছেলে বলিয়া অজয়েব সঙ্গে তাহার ঘনিষ্ঠতায় মন্দাব যেটুকু ভয় ছিল মাস্টারের মন্তব্য শোনার পর আর তাহা নাই। সুপ্ৰভা বকুলকে ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছে। বলে, কী মেয়ে আপনার বউদিদি, দিয়ে দিন মেয়েটা আমাকে, দেবেন ? বলে, মেয়ে বলে ওকে কিছু শেখাচ্ছেন না, এ তো ভালো কথা নয়? আজকালকাব দিনে লেখাপড়া গানটান না জানলে কে নেবে মেয়েকে ? একটু একটু সবই শেখাতে হবে ঠাকুরঝি । সুপ্ৰভাই উদ্যোগ করিয়া বকুলকে মেয়েস্কুলে ভর্তি করিয়া দিল, বলিল, স্কুলের মাহিনী সেই দিবে। গানটান শিখাইবার যখন উপায় নাই, লেখাপড়াই একটু শিখুক। বকুলকে সে যত্ন করে, লুকাইয়া ভালো জিনিস খাইতে দেয়, যে সব জিনিস শুধু মন্দা ও তার ছেলেমেয়ের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু একা বকুল ও সব খাইতে চায় না, বলে দাদাকে দাও, ভাইকে দাও। সুপ্ৰভা তাতে বড়ো খুশি হয়। কী নিঃস্বাৰ্থ মেয়েটার মন ? যেমন দেখিতে সুন্দর, তেমনি মিষ্টি স্বভাব, ও যেন রাজরানি হয়। ভগবান। রাজরানি? এতবার সুপ্রভা এই আশীর্বাদের পুনরাবৃত্তি করে কেন, বকুলকে রাজরানি করিতে এত তাহার উৎসাহ কীসের? রাজরানি হওয়ার শখ ছিল নাকি সুপ্রভার, মনে সেই ক্ষোভ রহিয়া গিয়াছে? কিছু বুঝিবার উপায় নাই। সুপ্রান্সাকে অসুখী মনে হয় কদাচিৎ। চুপচাপ বসিয়া সে অনেক সময়ই থাকে, সেটা তার স্বভাব, মুখ তাহার সব সময় বিমর্ষ দেখায় না, চোখে তাহার সব সময় ঘনাইয়া আসে না উৎসুক দিবা-স্বপ্নাতুরার দৃষ্টি, তবু শ্যামা মাঝে মাঝে সন্দেহ করে। অত যার বুপ সে কি একেবারেই নিজের মূল্য জানে না, কুমারী জীবনে আশা কি সে করে নাই, কল্পনা কি তার ছিল না? বুড়া বয়সে রাখাল যখন তাহাকে বিবাহ করিয়া তিন পুত্রের জননী সতিনের সংসারে আনিয়াছিল গোপনে সে কি দু একবিন্দু অশুপাত করে নাই? বাড়ি ভাড়ার কুড়িটা টাকা নিয়মিত আসে। দুমাস টাকা পাঠাইয়া কনক একবার শ্যামাকে একখানা পত্র লিখিল। পাশে কোনো বাড়িতে বিদ্যুতের আলো নেওয়া হইতেছে, দেখিয়া কনকের শখ জাগিয়াছে