পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩২০
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

তিনি সেই পরামর্শানুসারে কার্য করিতেন। কাজেই জমিদার, তালুকদার, ইজারদার গণ, ভীত ও চকিত অবস্থায় দেওয়ানজীর সন্তোষের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ভেট, উপহার, ডালিতে প্রতিদিন দেওয়ানজীর বাটী পরিপূর্ণ হইতে লাগিল। রাশি রাশি নজরে দেওয়ানজীর নজর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। অবশেষে নিজের ও গবর্নর জেনারেলের আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্তির জন্য জমিদার ও তালুকদারদিগের উপর অত্যাচার আরম্ভ হইল। সামান্য উৎকোচ দিয়া কাহারও নিস্তার ছিল না। যেরূপে হউক, ভূস্বামিগণ তাহাদের আশা পূর্ণ করিতে সচেষ্ট হইলেন। ক্রমে নিরীহ প্রজারা অত্যাচারে প্রপীড়িত হইয়া উঠিল। কিন্তু কে তাহাদের কথায় কর্ণপাত করে? গবর্নর জেনারেল ও দেওয়ানজী আপনাদের ক্ষতির আশঙ্কায় প্রজাদিগের কাতরােক্তিতে কর্ণপাত করিলেন না। তাহাদের কাতর কণ্ঠধ্বনি বিরাট আকাশে বিলীন হইতে লাগিল।

 জমিদারগণের নায়েব, গােমস্তা, উকিল, মুৎসুদ্দীতে দেওয়ানজীর বাসভবন প্রতিনিয়ত সমারােহময় হইতে লাগিল। আজ বঙ্গের দিকৃপাল জমিদারগণ ভয়ে গঙ্গাগােবিন্দের শরণাপন্ন হইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্রগণের মধ্যে বিষয়ের বিভাগ লইয়া বিবাদ উপস্থিত হওয়ায়, পুত্র শম্ভুচন্দ্র গঙ্গাগােবিন্দেরর শরণাপন্ন হন। শুনা যায়, রাজা বিপদ দেখিয়া দেওয়ানজীকে লিখিয়া পাঠাইলেন, “দরবার অসাধ্য, পুত্র অবাধ্য, ভরসা কেবল গঙ্গাগােবিন্দ", কিন্তু গঙ্গাগােবিন্দ তাহাতেও কর্ণপাত করেন নাই। শম্ভুচন্দ্রের মুখে তদীয় পিতা ও কর্মচারিগণ কর্তৃক স্বীয় নিন্দাবাদশ্রবণে সিংহ ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় কৃষ্ণচন্দ্রের সমস্ত প্রার্থনা নিষ্ফল করিয়া, শম্ভুচন্দ্রকে নদীয়ার জমিদারী দিবার জন্য গবর্নর জেনারেলকে পরামর্শ প্রদান করেন। কথিত আছে, রাজার সর্বনাশ উপস্থিত দেখিয়া তদীয় দেওয়ান কালীপ্রসাদ বণিবেশে হেস্টিংসপত্নীকে একছড়া মুক্তা-মালা প্রদান করিয়া সে যাত্রা রাজাকে অপমান হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন।[১] এইরূপে বাঙ্গলার সমস্ত রাজা ও জমিদার আপনাদিগের পিতৃপুরুষদিগের মান ও সম্পত্তি রক্ষা করিবার জন্য দেওয়ানজীর মনস্তুষ্টিসাধনে বিশেষরূপে চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 গঙ্গাগােবিন্দ নিজ পুত্রকে নায়েব-দেওয়ানের পদ প্রদান করিয়া, কার্যের আরও সুবিধা করিয়া তুলিলেন। প্রথমতঃ পুত্রের দ্বারা সমস্ত কার্য চালাইতে থাকেন এবং নিজের আবশ্যকমত ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া, আপনার ও স্বীয় প্রভু হেস্টিংসের আশালতাকে পরিবর্ধিত করিবার জন্য জমিদার ও প্রজাদিগের রক্ত শােষণ করিয়া, তাহাদের মূলে সেচন করিতে লাগিলেন। তাহারই ইঙ্গিতমাত্রে সমস্ত রাজস্ববিভাগ পরিচালিত হইত। কাহারও প্রতিবাদ করিবার ক্ষমতা ছিল না। দেশীয় কর্মচারিগণ দূরে থাকুক্, অনেক ইউরােপীয় কর্মচারীও প্রতিবাদে সাহসী হইতেন না।

  1. ক্ষিতীশবংশাবলী-সপ্তদশ অধ্যায়।