লইয়া তাহাদিগকে প্রতিনিয়ত উপহার প্রদান করিতে লাগিলেন। এক কথায় দেবী সেই সমস্ত ইংরেজ যুবকদিগের জন্য একটি নর্তকীসমাজ গঠন করিলেন এবং যখনই তাহাদের বিলাস-প্রবৃত্তির পরিতুষ্টির প্রয়োজন হইত, অমনি দেবীসিংহ তাহাদিগকে লইয়া উপস্থিত হইতেন। দৌলৎজান, দেলখোশ প্রভৃতি তাহাদের সুমধুর নাম, শ্বেতাঙ্গ যুবকদিগের কর্ণে ভাল লাগত।[১] তাঁহারা তাহাদিগকে লইয়া অশেষপ্রকার। আমোদ উপভোগ করিতেন। কখনও বা মুর্শিদাবাদের ভিন্ন ভিন্ন উদ্যানে, কখনও বা ভাগীরথীবক্ষে ময়ূরপক্ষী-আরোহণে সেই সুকণ্ঠীগণের কলকষ্ঠ ও কুটিল কটাক্ষ তাহাদিগকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় করিয়া রাখিত। সেই সময়ে ফরাসীদেশজাত সুস্বাদু মদ্য তাহাদের আমোদের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করিত। এতদ্ভিন্ন সুগন্ধি চুরুটের ত কথাই ছিল না। তাহাদের স্বদেশীয় ও বিদেশীয় যত প্রকার আমোদের সম্ভব, সকলেরই অভিনয় চলিতে থাকিত। যখন সেই তপ্তকাঞ্চনবর্ণা পূর্ণদেহা নর্তকীগণ ফরাসীদেশজাত মদ্যে গণ্ডস্থল রক্তিম করিয়া ঢুলু ঢুলু নয়নে ও অর্ধস্থলিত স্বরে নানারূপ বিভ্রমচেষ্টা দেখাইত, তখন সেই সুরামত্ত যুবকগণ যেরূপ পাশব প্রবৃত্তির পরিচয় প্রদান করিত, তাহা লিখিয়া লেখনী কলঙ্কিত করা যায় না। তখন তাহার সুসভ্য ইউরোপের সন্তান বলিয়া আপনাদিগকে ভুলিয়া যাইত এবং নিতান্ত অসভ্য বা ইতর জাতির বংশধরের ন্যায় আপামর সাধারণের চক্ষে প্রতিপন্ন হইত।
আমরা ইংরেজী ইতিহাসে মুসলমান বাদশাহ ও নবাবদিগের এইরূপ বিলাসিতার অনেক চিত্র দেখিয়া থাকি। তাঁহারা সর্বদা নর্তকীপরিবেষ্টিত হইয়া আমোদ-প্রমোদে বিভোর থাকিতেন, কখনও রাজকার্যে মনোনিবেশ করিতেন না। কিন্তু ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ তাহাদের স্বদেশবাসী ও কোম্পানীর রাজত্বের প্রারম্ভকালের শাসনকর্তাদিগের চিত্র একবার স্মরণ করিবেন কি? যদি ইংরেজরাজত্বের আরম্ভে তাহার সহিত মুসলমানরাজত্বের কোনই পার্থক্য দেখিতে না পাই, যে অত্যাচার সত্যই হউক, মিথ্যাই হউক, মুসলমনিরাজত্বে প্রবল ছিল বলিয়া আমরা তথাকথিত ইতিহাসসমূহে দেখিতে পাই, যে বিলাসিতার জন্য মুসলমানরাজত্বের পতন বলিয়া এক প্রকার স্বীকার করা যাইতে পারে, সেই সমস্ত পূর্ণমাত্রায় যদি ইংরেজশাসনের প্রথমে দেখিতে পাই, তবে মুসলমানরাজত্বের অবসানের পর ইংরেজবণিগরাজত্বে প্রজারা সুখী হইয়াছিল, এ কথা কেমন করিয়া স্বীকার করিব? সকলের স্মরণ রাখা আবশ্যক, আমরা বর্তমান রাজত্বের কথা বলিতেছি না। যে সময়ে কোম্পানীর প্রথম রাজত্বের আরম্ভ হয়, সেই সময়েরই কথা বলিতেছি।
- ↑ বার্ক লিখিয়াছেন যে, দেবীসিংহ তাহাদিগকে ঐ সকল সুমিষ্ট নামে অভিহিত করিত, কিন্তু সে কথা প্রকৃত নহে। এতদ্দেশে নর্তকীগণের সাধারণতঃ ঐ সকল নাম দেখা যায়, তাঁহারাই ইচ্ছা করিয়া ঐ সকল নাম ব্যবহার করে। সুতরাং দেবীসিংহকে নূতন করিয়া ঐ সমস্ত নাম প্রদান করার বিশেষ প্রয়োজন দেখা যায় না।