পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩৪৪
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

 আমরা শুনিয়া থাকি যে, মুসলমানরাজত্বের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া, তৎকালীন ইংরেজ বণিগরাজত্বে প্রজাগণ নাকি সুখী হইয়াছিল। সেইজন্য আমরা দেখাইলাম যে, তদুভয়ের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য অনুভব করিতে পারা যায় না। বরং বাদশাহ নবাবগণ কেবল প্রাচ্য আমোদ-প্রমোদে বিভোর থাকিতেন; কিন্তু দেখিতে পাওয়া যায়, কোম্পানীর প্রথম সময়ের শাসনকর্তৃগণ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়বিধ বিলাসিতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত দেখাইয়া গিয়াছেন এবং তাহাদের কোন কোন অত্যাচার সুসভ্য ইউরোপীয় প্রথানুযায়ীও ছিল।

 অনেকে মনে করিতে পারেন যে, দেবীসিংহের জন্য তাঁহারা এরূপ বিলাসতরঙ্গে গা ঢালিয়া দেন; অবশ্য এ কথা স্বীকার্য। কিন্তু যাঁহারা প্রলোভনের হস্ত হইতে আমাদিগকে রক্ষা করিতে সমর্থ না হন, তাঁহারা কোন বিস্তৃত প্রদেশের শাসনের কিরূপ উপযোগী, তাহাও একবার চিন্তা করিয়া দেখা উচিত। বাস্তবিকই দেবীসিংহ সেই সকল তরুণবয়স্কদিগকে সর্বদা বিলাসেই ভাসাইয়া রাখিতেন। যখন তাহাদের যে সমস্ত বিলাস-সামগ্রীর প্রয়োজন হইত, দেবীসিংহ অমনি তৎক্ষণাৎ তাহাদের নিকট সেই সকল উপস্থিত করিতেন। সমস্ত সামগ্রীই পূর্ব হইতে সংগ্রহ করিয়া রাখা হইত। কেবল যে বিলাস-দ্রব্যে তাহাদিগকে বশীভূত করিয়া রাখিতেন এমন নহে, যখনই তাহাদের অর্থের প্রয়োজন হইত, দেবীসিংহ তৎক্ষণাৎ তাহাই প্রদান করিতেন। যে অর্থের প্রলোভনে স্বয়ং হেস্টিংসসাহেব দেবীসিংহের বশবর্তী হইয়া পড়েন, তাহার মাহাত্মে এই কয়জন অল্পমতি ইংরেজ যুবক যে অত্যল্প আয়াসেই তাহার করতলগত হইবেন ইহাতে আর বৈচিত্র্য কি।

 এইরূপে দেবীসিংহ স্বীয় উচ্চতর কর্মচারীদিগকে বিলাসমুগ্ধ করিয়া, আপনার কার্যোদ্ধারে সচেষ্ট হন। তিনি নিজে কোন প্রকার আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত থাকিতেন না। যৎকালে বিলাসবিতোর ইংরেজ কর্মচারিগণ আপনাদের কর্তব্য বিস্মৃতির অতল গর্ভে নিমগ্ন করিয়া পশুরও অধম হইয়া উঠিলেন, সেই সময়ে দেবীসিংহ রাজস্ব সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য নিজ হস্তে লইয়া আপনার অর্থোপার্জনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তিনি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে জমিদারীর ইজারা বন্দোবস্ত করিয়া লইতে আরম্ভ করিলেন। কখনও স্বনামে কখনও বা বেনামীতে তাহার কার্যোদ্ধার হইতে লাগিল এবং নানারূপ প্রতারণায়, প্রবঞ্চনায় তাহার সম্পত্তি দিন দিন বধিত হইয়া উঠিল। রাজস্বসংক্রান্ত যে সমস্ত ভার তাহার হস্তে ন্যস্ত ছিল, তাহা হইতে তিনি যথেষ্ট লাভ করিলেন। ক্রমে ক্রমে মুর্শিদাবাদ প্রদেশের রাজস্ব কোম্পানীর ভাণ্ডারে সঞ্চিত না হইয়া, দেবীসিংহের সম্পত্তির সহিত একীভূত হইয়া গেল।

 যখন কোম্পানীর প্রায় সমস্ত রাজস্ব দেবীসিংহের হস্তগত হইবার উপক্রম হইল, তখন উধ্বতন কর্মচারিগণের চৈতন্যোদয় হয়। বিরেক মনুষ্যহৃদয় হইতে একেবারে চিরবিদায় লইতে পারে না। জগতে ক্রিয়ার পর প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। কাজেই সেই বিশাসবিভোর ইংরেজ যুবকগণের চমক ভাঙ্গিয়া গেল। তাঁহারা যেন বহুকালের