পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩৫৪
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

লুষ্ঠিত হইল। ভাবশিষ্ট দুই একখানি কুটীর ভস্মস্থূপের কলেবর বৃদ্ধি করিয়া, কোম্পানীর শান্তিময় রাজত্বের পরিচয় দিতে লাগিল। এককথায় সমস্ত উত্তরবঙ্গ জনমানবহীন হইয়া শশান অপেক্ষাও ভয়াবহ হইয়া উঠিল। দেবীসিংহ এক কপর্দকও কর না পাওয়ায়, কোম্পানীর রাজস্ব প্রদান করিতে পারিলেন না।

 যখন কর্তৃপক্ষগণ দেখিলেন যে, দেবীসিংহের রাজস্ব অনেকদিন হইতে পাওয়া যাইতেছে না এবং সেই সকল অত্যাচারের কথা অবিরত শ্রবণ করিয়া যখন তাহাদের কর্ণ বধির হইবার উপক্রম হইল, তখন তাঁহারা লজ্জার ভয়ে সেই ভীষণ অত্যাচারের অনুসন্ধান করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। তাঁহারা প্যাটারসন নামক একজন ন্যায়পর ইংরেজকে কমিশনার নিযুক্ত করিয়া রঙ্গপুরে পাঠাইলেন। প্যাটারস অত্যন্ত নির্ভীক ও সাধুপ্রকৃতির লোক ছিলেন; তিনি কদাচ আপনাকে ন্যায়পথ হইতে বিচলিত করিতে ইচ্ছা করিতেন না। রঙ্গপুরপ্রদেশে উপস্থিত হইয়া, প্যাটারসন প্রজাদিগের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখিয়া এইরূপ লিখিয়া পাঠাইলেন,-"রঙ্গপুর ও দিনাজপুর প্রদেশের প্রজাগণের উপর রাজস্ব অনাদায়ের জন্য যেরূপ কঠোর শাস্তি প্রদান করা হইয়াছে, সেই সকল দৃষ্টান্ত দ্বারা আপনাদিগের মনশ্চাঞ্চল্য উপস্থিত না করিয়া, সেগুলিকে চিরযবনিকাবৃত করিয়া রাখিবার ইচ্ছা করি। কিন্তু আমার নিকট যতই অপ্রীতিকর হউক না কেন, ন্যায়, মনুষ্যত্ব এবং গবর্নমেন্টের সম্মানের জন্য যাহাতে ভবিষ্যতে এরূপ অত্যাচার স্রোত পুনঃ প্রবাহিত না হয়, তজ্জন্য আমাকে সমস্তই অবগত করাইতে হইবে।”

 তাহার পর প্যাটারসন্সাহেব ক্রমাগত দেশের চতুদিকের অবস্থা দেখিতে লাগিলেন; প্রতিদিন শত শত ভগ্নাবশেষ কুটীর তাহার চক্ষের সম্মুখে পড়িতে লাগিল, শত শত আহত ব্যক্তি আপনাদিগের দুঃখকাহিনী বিবৃত করিতে প্রবৃত্ত। হইল। কাহারও পুত্র যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছে, কাহারও ভ্রাতা কারাগারে অনাহারে দিন যাপন করিয়াছে, কাহারও কন্যার পবিত্রতা অপহৃত হইয়াছে, কাহারও ভগিনী পিশাচদিগের বেদ্বারা ক্ষত বিক্ষত হইয়াছে, এই সমস্ত শুনিয়া এবং নিজে প্রত্যক্ষগোচর করিয়া, সেই ন্যায়বান ব্রিটনসন্তানের হৃদয় বিচলিত হইল। তিনি বিলক্ষণরূপে বুঝিতে পারিলেন যে, পৃথিবীর কোন স্থানে কোন যুগে এইরূপ পাশবিক অত্যাচার হয় নাই। কমশঃ তাহার অনুসন্ধানের ফলে অনেক নূতন নূতন ব্যাপার জনসাধারণের গোচরীভূত হইতে লাগিল। দেবীসিংহ নিজের অত্যন্ত বিপদ উপস্থিত দেখিয়া, আপনার চির প্রথানুযায়ী অর্থপ্রলোভনে প্যাটারসনুকে বশীভূত করিবার প্রয়াস পাইলেন। কিন্তু প্যাটারসনের প্রকৃতি সেরূপ ছিল না; সামান্য অর্থের প্রলোভন তাহাকে ন্যায়পথ হইতে বিচলিত করিতে পারিল না। তৎকালে কোম্পানীর অন্যান্য যাবতীয় কর্মচারী অর্থের দাস ছিলেন। গবর্নর জেনারেল হইতে সামান্য কর্মচারী পর্যন্ত সকলেই সেই প্রলোভনে মুগ্ধ হইয়া পড়িতেন। প্যাটারসনের প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায়, সেই সকল লোকদিগের কৌশলে