পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
ব্যারা
৩৬৫

উৎসবে মুণিদাবাদস্থ শ্বেত প্রভুগণের অতি সমাদরে ভোজনক্রিয়া নির্বাহের কথা শুনা যায়। ঘন ঘন তোপধ্বনি উৎসবের গাম্ভীর্য বৃদ্ধি করিত।

 এক্ষণে দরবারাদি আর কিছুই হয় না। যে দিন হইতে বাঙ্গলার শেষ নবাবনাজিম ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের নিকট আপনার উপাধি বিক্রয় করিয়াছেন, সেই দিন হইতে মুর্শিদাবাদের শেষ গৌরবও বিলুপ্ত হইয়াছে। নবাব-নাজিমের মাতা রেইসউন্নেসা বেগমের একখানি স্বতন্ত্র ব্যারার বন্দোবস্ত ছিল; তাহার মৃত্যুর পর তাহারও শেষ হইয়াছে। বাঙ্গলার শেষ নবাব-নাজিমের সহিত মুর্শিদাবাদের দুই একটি উৎসবও লয় পাইয়াছে।

 ‘নাওয়াড়া’ নামে আর একটি সমারোহপূর্ণ উৎসবের উল্লেখ দেখা যায়। সিরাজউদ্দৌলা ইহার প্রবর্তক বলিয়া কথিত। এক্ষণে তাহার চিহ্নমাত্রও নাই। বর্ষার প্রারম্ভে নিজামতের নানা প্রকারের যাবতীয় নৌকা সংস্কৃত ও সুসজ্জিত করা হইত। ব্যারার পূর্ব বৃহস্পতিবার অপরাহুকালে সমুদায় সুসজ্জিত নৌকা একস্থলে সমবেত করার প্রথা ছিল। কর্ণধার ও নাবিকগণ সুরঞ্জিত পরিচ্ছদে বিভূষিত হইয়া, নৌকাচালনার জন্য প্রস্তুত থাকিত।[১] এই সময়েও সেই সুসজ্জিত তরণীবক্ষে দরবার বসিবার কথা শুনা যায়। দেবীচৌধুরাণীর বজরাস্থ দরবারের কথা অনেকের স্মরণ থাকিতে পারে। বাস্তবিকই পূর্বে মুর্শিদাবাদে নৌকাবক্ষে এইরূপ দরবারের অধিবেশন হইত। গাঁড়ামন, হাতীমদন, রংমহাল, ময়ূরপঙ্খী, মৎস্যমুখী, মকরমুখী, হংসমুখী প্রভৃতি অনেক প্রকার সুন্দর সুসজ্জিত তরণী এই উৎসবের সময় ভাগীরথীকে শোভাশালিনী করিয়া তুলিত। একখানি সুবৃহৎ তরণীর চতুষ্পর্শ্বে অন্যান্য যাবতীয় তরণী মিলিত হইয়া, ভাগীরথীবক্ষে ভাসমান হইত। বৃহৎ তরণীতে দরবার বসিত, দরবারের সম্মুখে গায়িকাগণের সুস্বর সুদূর অম্বরপথ স্পর্শ করিবার নিমিত্ত ক্রমশঃ উখিত হইত। তরণী ভাসমান হইবার পূর্বে, অসংখ্য কদম্বপুষ্পের মালা ভাগীরথী হৃদয়ে ভাসাইয়া দেওয়ার রীতি ছিল। নীল মেঘের ছায়া ভাগীরথীকে নীলিমাময়ী করিয়াছে, সেই সময়ে কদম্বমালায় বিভূষিত হইয়া তিনি যমুনা বলিয়া মোৎপাদন করিতেন। নাওয়াড়া উৎসব এক্ষণে আর সম্পন্ন হয় না।

 ব্যারাপর্বের উৎপত্তি লইয়া মতভেদ দৃষ্ট হয়। বাবু ভোলানাথ চন্দ্র বলেন যে, বাঙ্গলার কোনও প্রাচীন রাজা সলিল-সমাধি হইতে রক্ষা পাওয়ায়, তাহার স্মরণোদ্দেশে এই উৎসব সম্পন্ন হইয়া থাকে। রাজার নৌকা জলমগ্ন হওয়ায়, তিনি সলিলগর্ভে প্রবেশের উপক্রম করেন। কোন স্থানে তিনি নিমগ্ন হইতেছিলেন, তাহার অনুচরের অন্ধকারে জানিতে পারে নাই, এমন সময়ে কতিপয় সুন্দরী রমণী নারিকেলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৌকা পুষ্পমালায় সুসজ্জিত করিয়া, এক একটি প্রজ্বলিত প্রদীপের সহিত যুগপৎ জলে ভাসাইয়া দেওয়ায়, তাহাদের আলোকে রাজানুচরগণ রাজাকে দেখিতে পায়;

  1. বঙ্কিমচন্দ্র অনেক দিন মুর্শিদাবাদে ছিলেন। সম্ভবতঃ তিনি নাওয়াড়া-দরবার স্মরণ করিয়া, দেবীর বজরা দরবারের কথা লিখিয়া থাকিবেন।