পাতা:মৃণালিনী - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
এত দিনের পর।
১৩৯

 হেমচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন তোমাকে হৃষীকেশ গৃহবহিস্কৃত করিয়া দিল?”

 মৃণালিনী হেমচন্দ্রের হৃদয়মধ্যে মুখ লুকাইলেন। অতি মৃদুরবে কহিলেন, “তোমাকে কি বলিব! হৃষীকেশ আমাকে কুলটা বলিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে!”

 শ্রুতমাত্র তীরের ন্যায় হেমচন্দ্র দাঁড়াইয়া উঠিলেন। মৃণালিনীর মস্তক তাঁহার বক্ষশ্চ্যুত হইয়া সোপানে আহত হইল।

 “পাপীয়সি—নিজমুখে স্বীকৃত হইলি!” এই কথা দন্তমধ্য হইতে ব্যক্ত করিয়া হেমচন্দ্র বেগে প্রস্থান করিলেন। পথে গিরিজায়াকে দেখিলেন; গিরিজায়া, তাঁহার সজলজলদভীমমূর্ত্তি দেখিয়া চমকিয়া দাঁড়াইল। লিখিতে লজ্জা করিতেছে—কিন্তু না লিখিলে নয়। হেমচন্দ্র পদাঘাতে গিরিজায়াকে পথ হইতে অপসৃতা করিলেন। বলিলেন, “তুমি যাহার দূতী তাহাকে পদাঘাত করিলে আমার চরণ কলঙ্কিত হইত।” এই বলিয়া হেমচন্দ্র গৃহে চলিয়া গেলেন।

 যাহার ধৈর্য্য নাই, যে ক্রোধের জন্মমাত্র অন্ধ হয়, সে সংসারের সকল সুখে বঞ্চিত। কবি কল্পনা করিয়াছেন, যে কেবল অধৈর্য্য মাত্র দোষে বীরশ্রেষ্ঠ দ্রোণাচার্য্যের নিপাত হইয়াছিল। “অশ্বত্থামা হতঃ” এই শব্দ মাত্র শুনিয়া তিনি ধনুর্ব্বাণ ত্যাগ করিলেন। প্রান্তর দ্বারা সবিশেষ তত্ত্ব লইলেন না। হেমচন্দ্রের কেবল অধৈর্য্য নহে—অধৈর্য্য, অভিমান, ক্রোধ।

 শীতল সমীরণময়ী উষার পিঙ্গল মূর্ত্তি বাপীতীরবনে উদয় হইল। তখনও মৃণালিনী আহত মস্তক ধারণ করিয়া সোপানে বসিয়া আছেন। গিরিজায় জিজ্ঞাসা করিল,

 “ঠাকুরাণি, আঘাত কি গুরুতর বোধ হইতেছে?”

 মৃণালিনী কহিলেন, “কিসের আঘাত?”