পাতা:য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ষষ্ঠ পত্র: পাদটীকা

কথা নহে। পুরুষেরা স্বার্থপর বলিয়া ছেলে-পিলে মানুষ করে না, রাঁধেবাড়ে না, ইত্যাদি কথা যদি সত্য হয় তবে এ কথাও কেন না সত্য হইবে যে, স্ত্রীরা স্বার্থপর বলিয়া আপিসে বেরোয় না, লাঙল চষে না, মোট বয় না ইত্যাদি। অন্তঃপুর একটা কারাগার, অন্তঃপুরবাসিনীরা একটা বোবা জানোয়ার, পিতামাতাকে ভূমিষ্ঠ হইয়। প্রণাম করা দাসত্ব, এ-সকল ইংরাজি বাঁধি বোল ইংরাজের মুখেই শোভা পায়—বিশেষতঃ সেই-সব মানোয়ারীই বলো আর জানোয়ারই বলো তাঁহাদের মুখে যাহারা নারিকেলের ছোবড়া ভক্ষণ করিয়া তাহার অবশিষ্ট অংশকে আঁটি মনে করিয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। যে ব্যক্তি আপন পিঙ্গলনয়নে কল্পনার দূরবীক্ষণ প্রয়োগ করিয়া আমাদের অন্তঃপুরবাসিনীদিগকে কেবল শাসনভয়ে জড়সড় হইয়া সকল কার্য করিতে দেখে, যাহারা দেখে যে পতিকে রাঁধিয়া বাড়িয়া খাওয়ানোতে পতির প্রতি পত্নীর ভালোবাসা প্রকাশ পায় না, পত্নীর প্রতি পতির নির্দয় শাসনই প্রকাশ পায়; কুলরমণীরাযে যে-সে পুরুষের সঙ্গে আমোদ করিয়া বেড়ায় না সে কেবল পতির শাসনভয়ে, পতির প্রতি ভালোবাসা তাহার কারণ নহে; এমন-কি যাহারা পুত্রের ভূমিষ্ঠ প্রণামে পিতৃভক্তি দেখে না, দাসত্বমাত্রই দেখে; তাহারা আমাদের দেশীয় সভ্যতার ছোবড়াটুকুই সার পদার্থ, সুতরাং সেই মহার্হ সভ্যতাকে নিতান্ত অসার পদার্থ, মনে করিবে ইহা তো ধরাই আছে। কিন্তু তাহার প্রকৃত সার পদার্থ যে তাহার ভিতরকার শাঁস ইহা যদি একজন বাঙালিরও চক্ষে অঙ্গুলি দিয়া দেখাইতে হয় তবে সে বড়ো রহস্য। একজন বাঙালিকে যদি শিখাইতে হয় যে অন্তঃপুর গৃহিণীগণের কারাগার নহে, কিন্তু তাঁহাদের সাধের নিকেতন— পিতামাতার প্রতি পুত্রের নম্র ব্যবহার ভক্তি এবং ভালোবাসার নিদর্শন, তাহার মধ্যে কঠোরতা কিছুমাত্র নাই—স্ত্রীলোকেরা-যে যে-সে পুরুষের সঙ্গে মিলিয়া-মিশিয়া আমোদ করে না সে কেবল এই জন্যে যে, তাহাদের পবিত্র গার্হস্থ্যভাব আমোদপ্রমোদ অপেক্ষা সহস্রগুণ অধিক যত্নের ধন— এই-সকল ষৎপরোনান্তি দুরূহ বিষয়ের নিগূঢ় তত্ত্ব যদি বাঙালিকে শিক্ষা দিতে হয় তবে নূতন একটা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি না করিলে আর চলে না।

—ভারতী-সম্পাদক
১০৯