পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

দীর্ঘ রেলওয়ে-সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। গহ্বরটি উত্তীর্ণ হতে প্রায় আধ ঘণ্টা লাগল।

 এইবার ফ্রান্স্। দক্ষিণে এক জলস্রোত ফেনিয়ে ফেনিয়ে চলেছে। ফরাসী জাতির মতাে দ্রুত, চঞ্চল, উচ্ছ্বসিত, হাস্যপ্রিয়, কলভাষী। কিন্তু তাদের চেয়ে অনেক নির্মল এবং শিশুস্বভাব।

 ফ্রান্সের প্রবেশদ্বারে একবার একজন কর্মচারী গাড়িতে এসে জিজ্ঞাসা করে গেল আমাদের মাশুল দেবার যােগ্য জিনিস কিছু আছে কি না— আমরা বললুম, না। আমাদের একজন বৃদ্ধ সহযাত্রী ইংরাজ বললেন: I don't parlez-vous francais.

 সেই স্রোত এখনাে আমাদের ডান দিক দিয়ে চলেছে। তার পূর্বতীরে ‘ফার’ অরণ্য নিয়ে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। চঞ্চলা নির্ঝরিণী বেঁকে-চুরে, ফেনিয়ে-ফুলে, নেচে, কলরব ক’রে, পাথরগুলােকে সর্বাঙ্গ দিয়ে ঠেলে, রেলগাড়ির সঙ্গে সমান দৌড়বার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে এক-একটা লােহার সাঁকো মুষ্টি দিয়ে তার ক্ষীণ কটিদেশ পরিমাপ করবার চেষ্টা করছে। এক জায়গায় জলরাশি খুব সংকীর্ণ হয়ে এসেছে; দুই তীরের শ্রেণীবদ্ধ দীর্ঘ বৃক্ষগুলি শাখায় শাখায় বেষ্টন ক’রে দুরন্ত স্রোতকে অন্তঃপুরে বন্দী করতে বৃথা চেষ্টা করছে। উপর থেকে ঝর্‌না এসে সেই প্রবাহের সঙ্গে মিশছে। বরাবর পূর্বতীর দিয়ে একটি পার্বত্য পথ সমরেখায় স্রোতের সঙ্গে বেঁকে বেঁকে চলে গেছে। এক জায়গায় আমাদের সহচরীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হল। হঠাৎ সে দক্ষিণ থেকে বামে এসে এক অজ্ঞাত সংকীর্ণ শৈলপথে অন্তর্হিত হয়ে গেল।

 শ্যামল তৃণাচ্ছন্ন পর্বতশ্রেণীর মধ্যে এক-একটা পাহাড় তৃণহীন সহস্ররেখাঙ্কিত পাষাণকঙ্কাল প্রকাশ করে নগ্ন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে; কেবল তার মাঝে মাঝে এক-এক জায়গায় খানিকটা করে অরণ্যের

৯২