পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

খাল বিল বন বাদাড় ভাঙারাস্তা এবং পানাপুকুরের ধারে বাস করি। ক্ষেত থেকে দুমুঠো ধান আনি, মেয়েরা আঁচল ভ’রে শাক তুলে নিয়ে আসে, ছেলেরা পাঁকের মধ্যে নেমে চিংড়িমাছ ধরে আনে, প্রাঙ্গণের গাছ থেকে গােটাকতক তেঁতুল পাড়ি, তার পরে শুকনাে কাঠকুট্ সংগ্রহ করে এক বেলা অথবা দু বেলা কোনাে রকম করে আহার চলে যায়। ম্যালেরিয়া এসে যখন জীর্ণ অস্থিকঙ্কাল কাঁপিয়ে তােলে তখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে রৌদ্রে পড়ে থাকি, গ্রীষ্মকালে শুষ্কপ্রায় পঞ্চকুণ্ডের হরিদ্‌বর্ণ জলাবশেষ থেকে উঠে এসে ওলাউঠা যখন আমাদের গৃহ আক্রমণ করে তখন ওলাদেবীর পূজা দিই এবং অদৃষ্টের দিকে কোটরপ্রবিষ্ট হতাশ শূন্যদৃষ্টি বদ্ধ করে দল বেঁধে মরতে আরম্ভ করি। আমরা কি আমাদের দেশকে পেয়েছি না পেতে চেষ্টা করেছি? আমরা ইহলােকের প্রতি ঔদাস্য় ক’রে এখানে কেবল অনিচ্ছুক পথিকের মতাে যেখানে-সেখানে পড়ে থাকি এবং যত শীঘ্র পারি দ্রুতবেগে বিশ-পঁচিশটা বৎসর ডিঙিয়ে একেবারে পরলােকে গিয়ে উপস্থিত হই।

 কিন্তু, একি চমৎকার চিত্র! পর্বতের কোলে, নদীর ধারে, হ্রদের তীরে, পপ্লার-উইলাে-বেষ্টিত কাননশ্রেণী। নিষ্কণ্টক নিরাপদ নিরাময় ফলশস্যপরিপূর্ণ প্রকৃতি প্রতিক্ষণে মানুষের ভালােবাসা পাচ্ছে এবং মানুষকে দ্বিগুণ ভালােবাসছে। মানুষের মতাে জীবের এই তাে যােগ্য আবাসস্থান। মানুষের প্রেম এবং মানুষের ক্ষমতা যদি আপনার চতুর্দিককে সংযত সুন্দর সমুজ্জ্বল করে না তুলতে পারে তবে তরুকোটর গুহাগহবর বন’বাসী জন্তুর সঙ্গে তার প্রভেদ কী?

 ৮ সেপ্টেম্বর। পথের মধ্যে আমাদের প্যারিসে নাববার প্রস্তাব হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এই ট্রেন প্যারিসে যায় না।— একটু পাশ

৯৪