পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

করে বলছিল, ভাই, খাচ্ছ না যে! এ কেবল তােমাকে মিথ্যা কষ্ট দেওয়াই হল! তােমার যােগ্য আয়ােজন হয় নি! বক বােধ করি মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছিল, আহা, সে কী কথা! রন্ধন অতি পরিপাটি হয়েছে। কিন্তু শরীরগতিকে আজ আমার কেমন ক্ষুধা বােধ হচ্ছে না। পরদিন বকের নিমন্ত্রণে শৃগাল গিয়ে দেখেন, লম্বা ভাঁড়ের মধ্যে বিবিধ উপাদেয় সামগ্রী সাজানাে রয়েছে। দেখে লােভ হয়, কিন্তু তার মধ্যে শৃগালের মুখ প্রবেশ করে না। বক অনতিবিলম্বে লম্বচঞ্চুচালনা করে ভােজনে প্রবৃত্ত হল। শৃগাল বাহিরের থেকে পাত্রলেহন এবং দুটো-একটা উৎক্ষিপ্ত খাদ্যখণ্ডের স্বাদগ্রহণ করে নিতান্ত ক্ষুধাতুর ভাবে বাড়ি ফিরে গেল।

 জাতীয় ভােজে বিদেশীর অবস্থা সেই রকম. খাদ্যটা উভয়ের পক্ষে সমান উপাদেয়, কিন্তু পাত্রটা তফাত। ইংরাজ যদি শৃগাল হয় তবে তার সুবিস্তৃত শুভ্র রজতথালের উপর উদ্‌ঘাটিত পায়সান্ন কেবল চক্ষে দর্শন করেই আমাদের ক্ষুধিতভাবে চলে আসতে হয়, আর আমরা যদি তপস্বী বক হই তবে আমাদের সুগভীর পাথরের পাত্রটার মধ্যে কী আছে শৃগাল তা ভালাে করে চক্ষেও দেখতে পায় না— দূর থেকে ঈষৎ ঘ্রাণ নিয়েই তাকে ফিরতে হয়।

 প্রত্যেক জাতির অতীত ইতিহাস এবং বাহ্যিক আচার ব্যবহার তার নিজের পক্ষে সুবিধা, কিন্তু অন্য জাতির পক্ষে বাধা। এই জন্য ইংরাজসমাজ যদিও বাহ্যতঃ সাধারণসমক্ষে উদ্‌ঘাটিত, কিন্তু আমরা চক্ষুর অগ্রভাগটুকুতে তার দুই-চার ফোঁটার স্বাদ পাই মাত্র, ক্ষুধানিবৃত্তি করতে পারি নে। সর্বজাতীয় ভােজ কেবল সাহিত্যক্ষেত্রেই সম্ভব। সেখানে, যার লম্বা চঞ্চু সেও বঞ্চিত হয় না, যার লােল জিহ্বা সেও পরিতৃপ্ত হয়।

 কারণটা সাধারণের হৃদয়গ্রাহী হােক বা না হােক, এখানকার

১০৮