পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

 উজ্জ্বল উত্তপ্ত দিন। এক রকম মধুর আলস্যে পূর্ণ হয়ে আছি। য়ুরােপের ভাব একেবারে দূর হয়ে গেছে। আমাদের সেই রৌদ্রতপ্ত শ্রান্ত দরিদ্র ভারতবর্ষ, আমাদের সেই ধরাপ্রান্তবর্তী পৃথিবীর অপরিচিত নিভৃত নদীকলধ্বনিত ছায়াসুপ্ত বাংলাদেশ, আমার সেই অকর্মণ্য গৃহপ্রিয় বাল্যকাল, কল্পনাক্লিষ্ট যৌবন, নিশ্চেষ্ট নিরুদ্যম চিন্তাপ্রিয় জীবনের স্মৃতি এই সূর্যকিরণে― এই তপ্ত বায়ুহিল্লোলে— সুদুর মরীচিকার মতাে আমার দৃষ্টির সম্মুখে জেগে উঠছে।

 ডেকের উপরে গল্পের বই পড়ছিলুম। মাঝে একবার উঠে দেখলুম দু ধারে ধূসরবর্ণ বালুকাতীর— জলের ধারে ধারে একটু একটু বনঝাউ এবং অর্ধশুষ্ক তৃণ উঠেছে। আমাদের ডান দিকের বালুকারাশির মধ্যে দিয়ে একদল আরব শ্রেণীবদ্ধ উট বােঝাই করে নিয়ে চলেছে। প্রখর সূর্যালােক এবং ধুসর মরুভূমির মধ্যে তাদের নীল কাপড় এবং শাদা পাগড়ি দেখা যাচ্ছে। কেউ বা এক জায়গায় বালুকাগহ্বরের ছায়ায় পা ছড়িয়ে অলসভাবে শুয়ে আছে― কেউ বা নমাজ পড়ছে, কেউ বা নাসারজ্জু ধরে অনিচ্ছুক উটকে টানাটানি করছে। সমস্তটা মিলে খররৌদ্র আরব-মরুভূমির একখণ্ড ছবির মতাে মনে হল।

 ২৪ অক্টোবর। আমাদের জাহাজের মিসেস ―কে দেখে একটা নাট্যশালার ভগ্নাবশেষ বলে মনে হয়। সেখানে অভিনয়ও বন্ধ, বাসের পক্ষেও সুবিধা নয়। রমণীটি খুব তীক্ষ্ণধার―যৌবনকালে বােধ করি অনেকের উপর অনেক খরতর শর চালনা করেছে। যদিও এখনাে এ নাকে মুখে কথা কয় এবং অচিরজাত বিড়ালশাবকের মতাে ক্রীড়াচাতুরীশালিনী, তবু কোনাে যুবক এর সঙ্গে দুটো কথা বলবার জন্যে ছুতাে অন্বেষণ করে না, নাচের সময় আহ্বান করে না, আহারের সময় সযত্নে পরিবেশন করে না। তার

১২৬