পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

পুনর্বার যুগল মূর্তির সোৎসাহ পদচারণা এবং মৃদুমন্দ হাস্যালাপ আরম্ভ হল। কেবল দু-চার জন পাঠিকা উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদ থেকে কিছুতেই আপনাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না— দিবা-বসানের স্নান ক্ষীণালোকে একাগ্রনিবিষ্ট দৃষ্টিতে নায়ক-নায়িকার পরিণাম অনুসরণ করছে।

 দক্ষিণে জ্বলন্ত কনকাকাশ এবং অগ্নিবর্ণ জলরাশির মধ্যে সূর্য অস্ত গেল এবং বামে সূর্যাস্তের কিছু পূর্ব হতেই চন্দ্রোদয় হয়েছে। জাহাজ থেকে পূর্বদিগন্ত পর্যন্ত বরাবর জ্যোৎস্নারেখা ঝিক্‌ঝিক্‌ করছে। পূর্ণিমার সন্ধ্যা নীল সমুদ্রের উপর আপনার শুভ্র অঙ্গুলি স্থাপন করে আমাদের সেই জ্যোৎস্নাপুলকিত পূর্ব ভারতবর্ষের পথ নির্দেশ করে দিচ্ছে।

 জাহাজের ডেকের উপরে এবং কক্ষে কক্ষে বিদ্যুদ্দীপ জ্বলে উঠল। ছটার সময় ডিনারের প্রথম ঘণ্টা বাজল। বেশ পরিবর্তন উপলক্ষে সকলে স্ব স্ব কক্ষে প্রবেশ করলে। আধ ঘণ্টা পরে দ্বিতীয় ঘণ্টা বাজল। ভোজনগৃহে প্রবেশ করা গেল। সারি সারি নরনারী বসে গেছে। কারো-বা কালো কাপড়, কারো রঙিন কাপড়, কারোবা শুভ্রবক্ষ অর্ধ-অনাবৃত। মাথার উপরে শ্রেণীবদ্ধ বিদ্যুৎ-আলোক জ্বলছে। গুন্‌গুন্ আলাপের সঙ্গে কাঁটা-চামচের টুংটাং ঠুং ঠুং শব্দ উঠছে, এবং বিচিত্র খাদ্যের পর্যায় পরিচারকদের হাতে হাতে নিঃশব্দ স্রোতের মতো যাতায়াত করছে।

 আহারের পর ডেকে গিয়ে শীতলবায়ুসেবন। কোথাও বা যুবক যুবতী অন্ধকার কোণের মধ্যে চৌকি টেনে নিয়ে গিয়ে গুন্ গুন্ করছে, কোথাও বা দুজনে জাহাজের বারান্দা ধরে ঝুঁকে পড়ে রহস্যালাপে নিমগ্ন, কোনো কোনো যুড়ি গল্প করতে করতে ডেকের আলোক ও অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দ্রুতপদে একবার দেখা দিচ্ছে

১৩১