পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পরিশিষ্ট

আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ এই অবিশ্রাম কর্ম এবং জীবনসংগ্রামের মধ্যে একটা শ্রান্তি এবং সন্দেহ এসে ক্ষীণ স্বরে বলছে, ওগাে, একটু রোসো, একটু থামাে― এসব কী হচ্ছে একটু ভাবো, একটু ভাবতে সময় দাও। মানুষ কেবল হাঁস্‌ফাস্ করে খাটবার জন্যে হয় নি, মাঝে মাঝে চুপচাপ করে ভাবা আবশ্যক। যখনি একটা জাত আপনার কাজের হিসেব নিতে যায়, যখনি সে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে ‘এতদিন যা করলে তার থেকে অবশেষে হল কী’, তখনি বােঝা যায় তার পাক ধরতে আরম্ভ করেছে। যখন মানুষ কেবল কাজের প্রবাহে প্রাণের উৎসাহে আপনি কাজ করে যায় তখনি তার বল। য়ুরােপে এখন সকল বিষয়েরই নিকেশের খাতা বেরিয়েছে। ধর্ম বলো, মানবহৃদয়ের সহস্র উচ্চ-আশা মহৎপ্রবৃত্তি বলো, সকলেরই খানাতল্লাসি চলছে। একটা বড়াে বিশ্বাসের জায়গায় ছােটো ছােটো সহস্র মত বাস করছে। যেমন একটা বৃহৎ প্রাণীর মৃতদেহে সহস্র ক্ষুদ্র প্রাণী জন্মগ্রহণ করে— কিন্তু সেটা জীর্ণতারই লক্ষণ।

 এমন নয় যে আমাদের কিছুই নেই, আমরা একেবারে বর্বর জাতি। এমন নয় যে বেদুয়িনদের মতাে আমাদের মাথার উপরে কেবল শূন্য আকাশ এবং পায়ের নীচে উদাস মরুভূমি। আমরা একটি অত্যন্ত জীর্ণ প্রাচীন নগরে বাস করি— এত প্রাচীন যে এর ইতিহাস লুপ্তপ্রায় হয়ে গেছে, মানুষের হস্তলিখিত স্মরণচিহ্নগুলি শৈবালে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে— সেই জন্যে ভ্রম হচ্ছে এ নগর যেন মানব-ইতিহাসের অতীত, যেন প্রাচীন প্রকৃতির এক রাজধানী। মানবপুরাবৃত্তের রেখা লুপ্ত করে দিয়ে প্রকৃতি আপন শ্যামল অক্ষর এর সর্বাঙ্গে বিচিত্র আকারে লিখে রেখেছে—সহস্র বৎসরের বর্ষা আপন অশ্রুচিহ্ন রেখে গেছে এবং সহস্র বসন্ত এর প্রত্যেক

১৪২