পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পরিশিষ্ট

আলােড়ন ততই বেশি। সন্তোষ আর সুখ এক নয় সে কথা আমরাও জানি। আমরা যখন বলি সুখের চেয়ে সােয়াস্তি ভালাে তখনই স্বীকার করি সুখ ও সন্তোষ দুই স্বতন্ত্র পদার্থ। কিন্তু সুখের চেয়ে সন্তোষ আমরা প্রার্থনীয় মনে করি। কেননা দুর্বলের জন্য সুখ নয়— সুখ বলসাধ্য, সুখ দুঃখসাধ্য। অক্‌সিজেন যেমন প্রতি মুহূর্তে আমাদিগকে দগ্ধ করিয়া জীবন দেয়, মানসিক জীবনে সুখ সেই রকম আমাদের দাহ করে। যৌবনে এই দাহ যে রকম প্রবল বার্ধক্যে সে রকম নয়― কিন্তু তাই বলে বৃদ্ধেরা বলতে পারে না যে, তাপহ্রাসই যথার্থ জীবন এবং সন্তোষই যথার্থ সুখ। এই পর্যন্ত বলতে পারে ‘আমার পক্ষে আবশ্যক নেই’। অতএব, কোণে বসে য়ুরােপের সুখ য়ুরােপের প্রাণ অস্বীকার করবার কারণ দেখা যায় না।

 কেবল বিচার্য বিষয় এই, এর একটা সীমা আছে কি না। যতই প্রবৃত্তির উত্তেজনা ও আকাঙ্ক্ষার বিকাশ বাড়ছে ততই তার কিয়ৎপরিমাণ চরিতার্থতাও একান্ত দুর্লভ হয়ে উঠছে কি না। ততই জীবনের সফলতা লাভের জন্যে গুরুতর ক্ষমতার আবশ্যক হচ্ছে কি না এবং সে ক্ষমতা স্বভাবতই অপেক্ষাকৃত অল্পতর ও সুযােগ্যতর লােকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হচ্ছে কি না। এই রকমে উত্তরােত্তর দুঃখী লােকের সংখ্যা বাড়ছে কি না। সমাজে সুখবিভাগের যত বৈষম্য হয় ততই তার পক্ষে বিপদ কি না। ভারতবর্ষে যেমন জ্ঞানসম্পদ কেবল ব্রাহ্মণদের মধ্যে বদ্ধ হয়ে পড়েছিল ব’লে জ্ঞানের অনেক বিভাগের আরম্ভ মাত্র হয়েছিল কিন্তু পরিণতি হয় নি, চতুর্দিক্‌বর্তী বিপুল ভ্রান্ত সংস্কারের স্রোত এসে তাকে প্লাবিত কয়ে দিয়েছিল, তেমনি সৌভাগ্য যদি সমাজের এক অংশের মধ্যেই বন্ধ হতে থাকে তা হলে ক্রমে দারিদ্র্যদুঃখের সংঘর্ষে তা বিপর্যস্ত হয়ে যাবে কি না।

১৪৮