পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি : খসড়া

ধরে মৃতব্যক্তির প্রতিমূর্তি আছে। বােধ হয় আত্মীয়েরা এসে নানা রকম করে সাজিয়ে-গুছিয়ে যায়। এক জায়গায় সিঁড়ি দিয়ে নেবে মাটির নিচেকার একটা ঘরে গিয়ে দেখলুম স্তূপাকারে অসংখ্য মড়ার মাথা সাজানাে রয়েছে, বােধ হয় পুরােনাে গাের থেকে তুলে ঐকম করে রেখে দিয়েছে― কত বৎসরের কত সুখদুঃখের এই একমাত্র অবশেষ। ঐ বাক্যহীন, দৃষ্টিহীন, চিন্তাহীন নিশ্চল ভীষণ স্তূপের মধ্যে হয়তাে এমন অনেক মাথা আছে জীবিত অবস্থায় যার স্পর্শলাভ করলে অনেক হতভাগ্য কৃতার্থ হয়ে যেত। দৈবাৎ হয়তাে তাদের দুটো মাথা পরস্পর পাশাপাশি স্থাপিত হয়েছে― এখন কি ঐ অন্ধকার নেত্রকোটর দিয়ে তারা পরস্পরকে চিনতে পারছে। হায়, যে স্পর্শসুখ এক কালে এক মুহূর্তের জন্যে বহুমূল্যবান ছিল এখন তা চিরদিনের জন্যে নিস্ফল। উঃ― ঐ মাথাগুলাের ভিতরে কত চিন্তা কত স্মৃতি সঞ্চিত ছিল, কত দুরাশা ওর মধ্যে দুর্গ নির্মাণ করেছিল— ওদের মধ্যে থেকে যে-সকল চেষ্টা যে-সকল কার্য উদ্ভূত হয়েছিল তারা এখনাে এই পৃথিবীর কত দিকে কত আকারে প্রবাহিত হচ্ছে, তাদের চিরধাবিত বিচিত্র গতি কেউ বন্ধ করে দিতে পারে না— কেবল ওরাই চিররাত্রিদিনের মতাে নিশ্চল নিশ্চেষ্ট নির্জীব সৌন্দর্যলেশবিহীন। জীবন এবং সৌন্দর্য এই অসীম মনুষ্যলােকের উপরে যেন একটা চিত্রিত পর্দা ফেলে রেখেছে— আস্তে আস্তে পর্দা তুলে দেখাে, ভিতরে লাবণ্যবিহীন অস্থিকঙ্কাল, জ্যোতিহীন চক্ষুকোটর, এবং বুদ্ধিবিহীন কপালফলক। হঠাৎ যদি কোনাে নিষ্ঠুর শক্তি নরসংসার থেকে এই যবনিকা উঠিয়ে ফেলে তা হলে সহসা দেখা যায় সমস্ত পৃথিবী জুড়ে এই চুম্বনমধুর আরক্ত অধরপল্লবের অন্তরালে শুষ্ক শ্বেত দন্তপংক্তি কী বিকট বিদ্রূপের হাস্য করছে! পুরােনাে বিষয়, পুরােনা কথা― ঐ নরকপাল অবলম্বন করে অনেক নীতিজ্ঞ পণ্ডিত

২১৫