পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জীবনস্মৃতির প্রথম পাণ্ডুলিপি হইতে
‘গঙ্গা তীরে’ অধ্যায়ের সূচনাংশ

আরও তো অনেক জায়গায় ঘুরিয়াছি― ভালাে জিনিস, প্রশংসার জিনিস অনেক দেখিয়াছি; কিন্তু সেখানে তাে আমার এই মা’র মতাে আমাকে কেহ অন্ন পরিবেশন করে নাই। আমার কড়ি যে হাটে চলে না সেখানে কেবল সকল জিনিসে চোখ বুলাইয়া ঘুরিয়া দিনযাপন করিয়া কী করিব! যে বিলাতে যাইতেছিলাম সেখানকার জীবনের উদ্দীপনাকে কোনােমতেই আমার হৃদয় গ্রহণ করিতে পারে নাই। আমি আর-একবার বিলাতে যাইবার সময় পত্রে লিখিয়াছিলাম—

 ‘নীচেকার ডেকে বিদ্যুতের প্রখর আলােক, আমােদপ্রমােদের উচ্ছ্বাস, মেলামেশার ধুম, গানবাজনা এবং কখনাে কখনাে ঘূর্ণিনৃত্যের উৎকট উন্মত্ততা। এ দিকে আকাশের পূর্বপ্রান্তে ধীরে ধীরে চন্দ্র উঠছে, তারাগুলি ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে। সমুদ্র প্রশান্ত ও বাতাস মৃদু হয়ে এসেছে; অপার সমুদ্রতল থেকে অসীম নক্ষত্রলােক পর্যন্ত এক অখণ্ড নিস্তব্ধতা, এক অনির্বচনীয় শান্তি নীরব উপাসনার মতাে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। আমার মনে হতে লাগল— যথার্থ সুখ কাকে বলে এরা ঠিক জানে না। সুখকে চাব্‌কে চাব্‌কে যতক্ষণ মত্ততার সীমায় না নিয়ে যেতে পারে ততক্ষণ এদের যথেষ্ট হয় না। প্রচণ্ড জীবন ওদের যেন অভিশাপের মতাে নিশিদিন তাড়া করছে; ওরা একটা মস্ত লােহার রেলগাড়ির মতাে চোখ রাঙিয়ে, পৃথিবী কাঁপিয়ে, হাঁপিয়ে, ধুঁইয়ে, জ্ব’লে, ছুটে প্রকৃতির দুই ধারের সৌন্দর্যের মাঝখান দিয়ে হুস্ করে বেরিয়ে চলে যায়। কর্ম বলে একটা জিনিস আছে বটে, কিন্তু তারই কাছে আমাদের মানবজীবনের সমস্ত স্বাধীনতা বিকিয়ে দেবার জন্যেই আমরা জন্মগ্রহণ করি নি— সৌন্দর্য আছে, আমাদের অন্তঃকরণ আছে;

২৫৬