পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

চোপড়টার মতো সর্বদা সিন্ধুকের মধ্যে তুলে রাখে— মনুষ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ কখনোই তার দ্বারা সম্ভব হয় না।

 আত্মার আন্তরিক পবিত্রতার প্রভাবে বাহ্য মলিনতাকে কিয়ৎপরিমাণে উপেক্ষা না করলে চলে না। অত্যন্ত রূপপ্রয়াসী ব্যক্তি বর্ণবিকারের ভয়ে পৃথিবীর ধুলামাটি জলরৌদ্র বাতাসকে সর্বদা ভয় করে চলে এবং ননীর পুঁতুলটি হয়ে নিরাপদ স্থানে বিরাজ করে; ভুলে যায় যে, বর্ণসৌকুমার্য সৌন্দর্যের একটি বাহ্য উপাদান, কিন্তু স্বাস্থ্য তার একটি প্রধান আভ্যন্তরিক প্রতিষ্ঠাভূমি— জড়ের পক্ষে এই স্বাস্থ্য অনাবশ্যক, সুতরাং তাকে ঢেকে রাখলে ক্ষতি নেই। কিন্তু আত্মাকে যদি মৃত আত্মা জ্ঞান না করো, যদি সে জীবন্ত আত্মা হয়, তবে কিয়ৎপরিমাণে মলিনতার আশঙ্কা থাকলেও তার স্বাস্থ্যের উদ্দেশে, তার বল-উপার্জনের উদ্দেশে, তাকে সাধারণ জগতের সংস্রবে আনা আবশ্যক।

 আধ্যাত্মিক বাবুয়ানা কথাটা কেন ব্যবহার করেছিলুম এইখানে তা বোঝা যাবে। অতিরিক্ত বাহ্যসুখপ্রিয়তাকেই বিলাসিতা বলে, তেমনি অতিরিক্ত বাহ্যপবিত্রতাপ্রিয়তাকে আধ্যাত্মিক বিলাসিতা বলে। একটু খাওয়াটি শোওয়াটি বসাটির ইদিক ওদিক হলেই যে সুকুমার পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হয় তা বাবুয়ানার অঙ্গ। এবং সকল প্রকার বাবুয়ানাই মনুষ্যত্বের বলবীর্যনাশক।

 কিন্তু হিন্দুধর্ম আমাদের খাওয়া শোওয়া বসা চলাফেরা সমস্ত অধিকার করে আছে এই ব’লে আমরা গর্ব করে থাকি— আমরা বলি আর-কোনো দেশে মানুষের ছোটোবড়ো প্রত্যেক কাজে, সমাজের উচ্চনীচ প্রত্যেক বিভাগে ধর্মের হস্তক্ষেপ নেই। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয় সেটা আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়।

 কারণ, তাতে করে হয় নির্বিকার ধর্মকে চঞ্চল পরিবর্তনের উপর

২১