পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

অদৃষ্টের অলক্ষ্মী নানা প্রলােভনে ভুলিয়ে আবার পথ থেকে পথে, দ্বার থেকে বারে, দেশ থেকে দেশান্তরে টেনে নিয়ে যায়।

 যখন দেখলুম আমার দশাই এই রকম, তখন মনকে এই বলে প্রবােধ দিলুম— তা, এক রকম ভালােই হয়েছে। কারণ, যদি অধিকার স্থাপন করতে চাও তা হলে অল্প পরিমাণের জন্যে বিশ্বসংসারের অধিকাংশই আপােষে ছেড়ে দিতে হয়। আর যদি কেবল দেখতে শুনতে, উপভােগ করতে চাও, তা হলে কিছুরই উপরে দাবি না ছেড়ে সর্বত্রই গতিবিধির পথ মুক্ত রাখা যায়।

 সেই কারণে আমি যখন য়ুরোপে গেলুম তখন কিছুই অধিকারের চেষ্টা করি নি। পথের উপর দিয়ে নয়ন মেলে চলে এলুম এবং মনে আপনি যা উদয় হল তাই সংগ্রহ করে নিয়ে এলুম— এ কেবল সাহিত্যের ছিটেবুনানি, এতে হাল লাঙল চাষ নিড়েনের কোন সম্পর্ক নেই।

 এরা কী করে এত সস্তায় দেশালাই তৈরি করে তা আমি দেখি নি; তা ছাড়া ইস্পাতের ছুরি, কাঁচের বাসন এবং কাপড়ের কল সম্বন্ধেও আমি কোনােরূপ সন্ধান করতে পারি নি।

 আমি কেবল দেখলুম জাহাজ চলছে, গাড়ি চলছে, লোক চলছে, দোকান চলছে, থিয়েটার চলছে, পার্লেমেণ্ট্ চলছে— সকলই চলছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল বিষয়েই একটা বিপর্যয় চেষ্টা অহর্নিশি নিরতিশয় ব্যস্ত হয়ে রয়েছে; মানুষের ক্ষমতার চূড়ান্ত সীমা পাবার জন্যে সকলে মিলে অশ্রান্তভাবে ধাবিত হচ্ছে।

 দেখে আমার ভারতীয় প্রকৃতি ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে বিস্ময়-সহকারে বলে—হাঁ, এরাই রাজার জাত বটে! আমাদের পক্ষে যথেষ্টের চেয়ে ঢের বেশি এদের কাছে তা অকিঞ্চনদারিদ্র্য। এদের অতি সামান্য় সুবিধাটুকুর জন্যেও, এদের অতি ক্ষণিক

৩৭