পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

হৃদয়ের উৎকণ্ঠা দূর হয়? তোমরা বাহিরে সুখী আমরা গৃহে সুখী, এখন আমাদের সুখ তোমাদের বোঝাই কী করে?

 একজন লেডি-ডফারিন স্ত্রীডাক্তার আমাদের অন্তঃপুরে প্রবেশ করে যখন দেখে অপরিচ্ছন্ন ছোটো কুঠরি, ছোটো ছোটো জালনা, বিছানাটা নিতান্ত দুগ্ধফেননিভ নয়, মাটির প্রদীপ, দড়িবাঁধা মশারি, আর্ট্ স্টডিয়োর রঙ-লেপা ছবি, দেয়ালের গাত্রে দীপশিখার কলঙ্ক এবং বহুজনের বহুদিনের মলিন করতলের চিহ্ন— তখন সে মনে করে কী সর্বনাশ, কী ভয়ানক কষ্টের জীবন, এদের পুরুষেরা কী স্বার্থপর, স্ত্রীলোকদের জন্তুর মতো করে রেখেছে! জানে না আমাদের দশাই এই। আমরা মিল পড়ি, স্পেন্সর পড়ি, রঙ্কিন পড়ি, আপিসে কাজ করি, খবরের কাগজে লিখি, বই ছাপাই, ঐ মাটির প্রদীপ জ্বালি, ঐ মাদুরে বসি, অবস্থা কিঞ্চিৎ সচ্ছল হলে অভিমানিনী সহধর্মিণীর গহনা গড়িয়ে দিই, এবং ঐ দড়িবাঁধা মোটা মশারির মধ্যে আমি, আমার স্ত্রী এবং মাঝখানে একটি কচি খোকা নিয়ে তালপাতার হাতপাখা খেয়ে রাত্রি যাপন করি।

 কিন্তু আশ্চর্য এই, তবু আমরা নিতান্ত অধম নই। আমাদের কৌচ কার্পেট কেদারা নেই বললেই হয়, কিন্তু তবুও তো আমাদের দয়ামায়া ভালোবাসা আছে। তক্তপোশের উপর অর্ধশয়ান অবস্থায় এক হাতে তাকিয়া আঁকড়ে ধরে তোমাদের সাহিত্য পড়ি, তবুও তো অনেকটা বুঝতে পারি এবং সুখ পাই; ভাঙা প্রদীপে খোলা গায়ে তোমাদের ফিলজফি অধ্যয়ন করে থাকি, তবু তার থেকে এত বেশি আলো পাই যে, আমাদের ছেলেরাও অনেকটা তোমাদেই মতো বিশ্বাসবিহীন হয়ে আসছে।

 আমরাও আবার তোমাদের ভাব বুঝতে পারি নে। কৌচকেদারা খেলাধুলা তোমরা এত ভালোবাস যে স্ত্রী পুত্র না হলেও

৪৩