পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

হৃদয়ে স্থান লাভ ক’রে সেখানে কত কবিত্ব কত সৌন্দর্য বিকাশ করেছে। উপদেশের দ্বারায় নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নজাতীয় ভাবের সহিত ঘনিষ্ঠ সংস্রবের দ্বারায় তার হৃদয়ের সার্বজনীন অধিকার যে কত বিস্তৃত করেছে তা আজ কে বিশ্লেষ করে দেখাতে পারে?

 সৌভাগ্যক্রমে আমরা যে শিক্ষা প্রাপ্ত হচ্ছি তাও আমাদের প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুগত নয়। এই জন্যে আশা করছি এই নূতন শক্তির সমাগমে আমাদের বহুকালের একভাবাপন্ন জড়ত্ব পরিহার করতে পারব, নবজীবনহিল্লোলের স্পর্শে সজীবতা লাভ করে পুনরায় নবপত্রপুষ্পে বিকশিত হয়ে উঠব, আমাদের মানসিক রাজ্য সুদূরবিস্তৃতি লাভ করতে পারবে।

 কেহ কেহ বলেন য়ুরােপের ভালাে য়ুরােপের পক্ষেই ভালাে, আমাদের ভালাে আমাদেরই ভালাে। কিন্তু কোনাে প্রকৃত ভালাে কখনােই পরস্পরের প্রতিযােগী নয়, তারা অনুযােগী। অবস্থা-বশতঃ আমরা কেহ একটাকে কেহ আর-একটাকে প্রাধান্য দিই, কিন্তু মানবের সর্বাঙ্গীণ হিতের প্রতি দৃষ্টি করলে কাউকেই দূর করে দেওয়া যায় না। এমন-কি, সকল ভালাের মধ্যেই এমন একটি পারিবারিক বন্ধন আছে যে, এক জনকে দূর করলেই আর-এক জন দুর্বল হয় এবং অঙ্গহীন মনুষ্যত্ব ক্রমশঃ আপনার গতি বন্ধ করে সংসারপথপার্শ্বে এক স্থানে স্থিতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয় এবং এই নিরুপায় স্থিতিকেই উন্নতির চূড়ান্ত পরিণাম বলে আপনাকে ভােলাতে চেষ্টা করে।

 গাছ যদি সহসা বুদ্ধিমান কিম্বা অত্যন্ত সহৃদয় হয়ে ওঠে তা হলে সে মনে মনে এমন তর্ক করতে পারে যে, মাটিই আমার জন্মস্থান, অতএব কেবল মাটির রস আকর্ষণ করেই আমি বাঁচব। আকাশের রৌদ্রবৃষ্টি আমাকে ভুলিয়ে আমার মাতৃভূমি থেকে আমাকে ক্রমশই

৫৪